কিয়ামুল লাইলের মর্যাদা অপরিসীম
সংগৃহীত ছবি।

ইসলামের  পথনির্দশঃ

রমজান একটি মাসের নাম। পুরো মাসের দিনগুলো যেভাবে রমজানের অংশ, রাতগুলোও সেভাবে রমজানের অংশ। দিনের ইবাদত হলো সিয়াম আর রাতের ইবাদত হলো কিয়াম। সিয়াম ও কিয়াম দুটিই যথাযথভাবে আদায় করার মাধ্যমে রমজানের দিন ও রাতের আমল পুরো হবে এবং মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুত ক্ষমা অর্জন করা সম্ভব হবে, ইনশাআল্লাহ।

দিনের আমল সিয়াম বা রোজার প্রতি যত্নশীল হলেও অনেকের মধ্যে রাতের আমল কিয়ামের ক্ষেত্রে অলসতা পরিলক্ষিত হয়। এখানে কিয়ামুল লাইল নিয়ে আলোচনা করা হলো—
কিয়ামুল লাইল : কিয়ামুল লাইল অর্থ হলো রাতে দাঁড়ানো। অর্থাৎ রাত জেগে দীর্ঘ কিরাতসহ নামাজ আদায় করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) এত দীর্ঘ কিরাতসহ নামাজ আদায় করতেন যে লম্বা সময় দাঁড়িয়ে থাকার কারণে তাঁর পা মোবারক ফুলে যেত।

একান্ত মনে নফল নামাজ, মনোযোগের সঙ্গে বিশুদ্ধভাবে কোরআন তিলাওয়াত, অশ্রুবিজড়িত অবস্থায় আল্লাহর কাছে তাওবা, ইস্তিগফার ও ক্ষমা প্রার্থনা ইত্যাদিও কিয়ামুল লাইলের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।   

কিয়ামুল লাইলের মর্যাদা : রমজানে কিয়ামুল লাইলের মর্যাদা অপরিসীম। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি রমজান মাসে পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে সওয়াবের আশায় কিয়াম করে আল্লাহ তার আগের সব পাপ ক্ষমা করে দেন।

বুখারি, হাদিস : ১৯০৫; মুসলিম, হাদিস : ১৮১৫) অন্য হাদিসে এসেছে, আমর ইবনে মুররা আল-জুহানি (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (সা.)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি সাক্ষ্য দিই যে আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, আপনি আল্লাহর রাসুল, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, জাকাত আদায় করি, রমজান মাসে রোজা রাখি এবং রাতে কিয়াম করি, তাহলে আমি কাদের অন্তর্ভুক্ত হব? নবী (সা.) বলেন, তুমি সিদ্দিক ও শহীদদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

(সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৩৪৩৮)

কিয়ামুল লাইলের সময়সীমা : রাসুলুল্লাহ (সা.) সারা বছর কমপক্ষে রাতের এক-তৃতীয়াংশ জাগরণ করে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমার রব তো জানেন যে তুমি জাগরণ করো কখনো রাতের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, কখনো অর্ধাংশ এবং কখনো এক-তৃতীয়াংশ। ’

(সুরা : মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ২০) রমজানে তাঁর জাগরণ আরো বেড়ে যেত। রমজানেও রাতের এক-তৃতীয়াংশ জাগরণ করে নামাজ আদায় করতে না পারা সীমাহীন ব্যর্থতা ছাড়া কিছু নয়। বর্তমানে রাত প্রায় ১০ ঘণ্টা (ভোর ৪:৩০, সন্ধ্যা ৬:৩০)।

সে ক্ষেত্রে কমপক্ষে শোয়া তিন ঘণ্টা রাত জাগরণ করে নামাজ আদায় করা বিশেষ ফজিলতপূর্ণ।

তারাবি নামাজ : রমজানে কিয়ামুল লাইলের বিশেষায়িত নামাজ হলো তারাবি। আবদুর রহমান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মহান আল্লাহ তোমাদের ওপর রমজানের রোজা ফরজ করেছেন আর আমি তোমাদের জন্য কিয়াম সুন্নত করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে এবং রাতে কিয়াম করবে, সে তার যাবতীয় পাপ থেকে নবজাতক শিশুর মতো পবিত্র হয়ে যাবে।

(নাসাঈ, হাদিস : ২২০৯)

এখানে কিয়াম বলে তারাবি নামাজকে বোঝানো হয়েছে। কারণ তারাবি রমজান মাসেই হয়ে থাকে, অন্য মাসে নয়। কাজেই রাত জেগে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে লম্বা কিরাতে তারাবি নামাজ আদায় করলে কিয়ামুল লাইল যথার্থ হবে। এ জন্য আস্তে-ধীরে খতমে কোরআনসহ ২০ রাকাত তারাবি নামাজ আদায় করা অতি সমীচীন। তাড়াহুড়া করে অথবা ২০ রাকাতের চেয়ে কম করে অথবা খতমে কোরআন ছাড়া তারাবি নামাজ পড়ে অন্য দিনের মতো সাধারণ সময়ে ঘুমিয়ে পড়লে কিয়ামুল লাইল যথার্থ হয় না। সাহাবায়ে কেরাম ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) এর যুগে ২০ রাকাত তারাবি, তিন রাকাত বিতরসহ ২৩ রাকাত আদায় করতেন। (মুয়াত্তা, হাদিস : ৩৮০)

তাহাজ্জুদ নামাজ : তাহাজ্জুদ হলো রাতের শেষাংশে আদায় করার নামাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) দীর্ঘ কিরাতসহ সাধারণত আট রাকাত তাহাজ্জুদ ও তিন রাকাত বিতর নামাজ আদায় করতেন। (বুখারি, হাদিস : ১০৯৬; মুসলিম, হাদিস : ১৭৫৭)

তবে অনেক সময় চার/ছয়/দশ/বারো রাকাতও আদায় করেছেন।

(বুখারি, হাদিস : ১০৮৮; মুসলিম, হাদিস : ১৮৪০)

তাহাজ্জুদ নামাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে কমপক্ষে দুই রাকাত হলেও তা আদায় করা উচিত। উল্লেখ্য যে তারাবি ও তাহাজ্জুদ এক নয়। দুটি ভিন্ন ভিন্ন নামাজ। তাহাজ্জুদ সারা বছর রাতের শেষাংশে আদায় করার নামাজ। পক্ষান্তরে তারাবি শুধু রমজান মাসে রাতের প্রথমাংশে আদায় করার নামাজ। ফরজ নামাজের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ হলো তাহাজ্জুদ। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদ নামাজ। (মুসলিম, হাদিস : ২৮১২)

রমজান মাসে শেষ রাতে সবাইকে সাহরি খেতে উঠতে হয়। সে ক্ষেত্রে একটু আগে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করলে রমজানের কিয়ামুল লাইলের পরিধিটা আরেকটু বৃদ্ধি পায় এবং সর্বোত্তম মাসে সর্বোত্তম নামাজ আদায় করার সুযোগ নেওয়া যায়।

আওয়াবিন নামাজ : আওয়াবিন হলো মাগরিব নামাজের পর ছয় রাকাত নামাজ। হাদিসে আওয়াবিন নামাজের বিনিময়ে ১২ বছরের ইবাদতের সওয়াব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। রমজান মাসে এ নামাজও নিয়মিত আদায় করে কিয়ামুল লাইলের পরিধি বাড়ানো যায়। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মাগরিব নামাজের পর কোনো ধরনের অহেতুক কথা না বলে কেউ ছয় রাকাত নামাজ আদায় করলে তাকে এর বিনিময়ে ১২ বছরের ইবাদতের সওয়াব দেওয়া হয়। (তিরমিজি, হাদিস : ৪৩৫; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১১৬৭)

এশা ও ফজর নামাজ জামাতে আদায় করা : রমজানের রাতে গুরুত্বের সঙ্গে এশা ও ফজর নামাজ জামাতে আদায় করাও কিয়ামুল লাইলের মধ্যে পড়ে। এ জন্য সাহরি ও ইফতারের চাপে যেন এ দুই নামাজের জামাত নষ্ট না হয়—সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। উসমান ইবনে আফফান (রা.) বলেন, রাসুল (সা.)-কে আমি বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি এশার নামাজ জামাতে আদায় করল, সে যেন অর্ধেক রাত ইবাদত করল। আর যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করল, সে যেন পুরো রাত ইবাদত করল। (মুসলিম, হাদিস : ১৫২৩)

এসব আমলের মাধ্যমে রমজানের অন্যতম অনুষঙ্গ কিয়ামুল লাইল পালন করার মাধ্যমে মহান আল্লাহর ক্ষমা পাওয়ার আশা করা যায়। আল্লাহ সবাইকে তাওফিক দান করুন। আমিন।