লিটন চৌধুরী । ।
গত পাঁচবছর ধরে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতায় সীতাকুণ্ড পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডের বাসিন্দারা ভারী বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে দিনের পর দিন পানিবন্দি ছিল তারা। এলাকাবাসী এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে ছুটে গেলে তারা প্রতিবারই মৌসুমের আগে সমাধানের আশ্বাস দেন। অথচ বর্ষা মৌসুমের আগে খাল সংস্কার ও পুনঃখনন না করা, খালের মুখে অকেজো স্লুইসগেটগুলো মেরামতের পদক্ষেপ, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ গ্রামীণ সড়কগুলোতে পানি চলাচলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করার কথা থাকলেও আজ অবধি কোন কাজই পৌর কর্তৃপক্ষ হাতে নেয়নি। বলা যায়, আসন্ন বর্ষায়ও সীতাকুণ্ড পৌরসভার বাসিন্দারা গত বর্ষার পরিণতি ভোগ করবে।
খাল সংস্কার ও পুনঃ খনন না করা, খালের মুখে স্লুইসগেটগুলো অকেজো থাকা, জলাশয় ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর-দোকানপাট নির্মাণ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, রেলসড়ক ও গ্রামীণ সড়কগুলোতে পানি চলাচলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা(ব্রিজ-কালভার্ট) না থাকায় সীতাকুণ্ড পৌরসভায় জলাবদ্ধতা সমস্যা স্থায়ীরূপ নিয়েছে। সীতাকুণ্ডে পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে গতবছর সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সীতাকুণ্ড পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে গত বছর পাঁচ দফা বন্যায় বাড়িঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে সম্পদ নষ্ট হয়েছে। ভেসে গেছে বহু পুকুর ও জলাশয়ের মাছ। মৎস্যসম্পদ ও কৃষিখাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গ্রামীণসড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়েছে। আমন বীজতলা ও শাকসবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
জানা গেছে, সীতাকুণ্ডের জলাবদ্ধতা নতুন কিছু নয়, দীর্ঘদিনের পুরোনো। তবে গত পাঁচ বছর ধরে তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। পৌর মেয়র-কাউন্সিলররা তাদের নিজ নিজ এলাকার জলাবদ্ধতার রূপ দেখেছেন। কিন্তু কার্যকরী কোন ভূমিকা পালন করছে না। এলাকাবাসীর অভিযোগ, জলবদ্ধতা সমস্যা দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অতীতের জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থীরা ভোটে জয়লাভ করেও তারা তাদের কথা রাখেননি।
পৌরসভার আমিরাবাদ, ইদিলপুর, দক্ষিণ মহাদেবপুর, শিবপুর, সোবহানবাগ এবং চৌধুরী পাড়ায় এলাকা সরেজমিনে দেখা গেছে, খালের বিভিন্ন অংশে প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করায় পানি নিষ্কাষণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। আমিরাবাদ এলাকায় ব্রীজ ও খালের অংশ দখল করে প্রভাবশালীরা বসতবাড়ী নির্মাণ করেছে। দাশ পাড়া এলাকার পাহাড়ি ঢলের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র খালটির অর্ধেক অংশ ভরাট করে একটি টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। অনেকে জায়গা ক্রয় করে বসত বাড়ি নির্মাণ করতে গিয়ে পাশের ছড়ার অংশ দখল করে নেয়। অভিযোগ আছে, অর্থের বিনিময়ে খালের অংশ অবৈধ দখলের সহযোগিতা করেছেন কেউ কেউ। পৌর এলাকায় জমির মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বসতঘর নির্মাণের সময় পানি চলাচলের কোনো পথ রাখেনি।
গতবছরের রেকর্ডে দেখা গেছে দুই ঘন্টার বৃষ্টিতে পৌর এলাকার বিভিন্নস্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে খালের দুইপাশে আগাছায় ভরপুর হয়ে গেছে। এতে পানি প্রবাহের পথে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। যার কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। সীতাকুণ্ড পৌর কর্তৃপক্ষ গত ৫বছরে খাল খনন বা খালের দু’পাশের আগাছা পরিস্কার করেনি। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড পৌর এলাকায় বাইপাসে দুইটি কালভার্ড নির্মাণ ছিল অপরিকল্পিত। প্রায় আধা কিলোমিটার সড়কটিতে পূর্বে পানি নিস্কাশনের জন্য পাঁচটি কালভার্ট ছিল। বর্তমানে তা দুইটি করা হয়েছে। তাও পূর্বের কালভার্টগুলোর চেয়ে সরু করা হয়েছে। তাছাড়া খালের সাথে কালভার্ড দুইটি সমন্বয় না থাকায় পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। যার কারণে পৌরসদরের সব কটি গ্রাম গত কয়েক বছর ধরে সামান্য বৃষ্টিতে প্লাাবিত হচ্ছে। এদিকে বশরতনগর এলাকার অপরিকল্পিতভাবে স্থাপিত রাবার ড্যামটি সীতাকুণ্ড পৌরসভা জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন একদশক আগে। অথচ জনপ্রতিনিধিরা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনো রাবার ড্যামটি অপসারণের কোন উদ্যোগ নেননি।
সীতাকুণ্ড পৌরসভার কাউন্সিলর দিদারুল আলম এপেলো জানান, ছড়া নালাগুলো দখলমুক্ত করা জরুরি। অন্যথায় প্রতিবছরই বন্যা-জলাবদ্ধতা হবে।
পৌরসভার প্রকৌশলী মো. নুরুন নবী জানান, সীতাকুণ্ডে বন্যা নয়, ফ্লাশ ফ্লাড হয়। পৌর এলাকার পানি প্রবাহের ছড়া, নালা ও খালগুলো বেদখল হওয়ায় সেগুলো পানি ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এসব অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা প্রয়োজন।
রাবার ড্যামের প্রসঙ্গে পৌর মেয়র আলহাজ্ব বদিউল আলম জানান, গতবছর পাঁচ দফা ভারি বর্ষণে বন্যা হয়েছে। পৌর সদরের মধ্যে ইদিলপুর, আমিরাবাদ ও শেখপাড়া ছড়া তিনটির পানি গিয়ে পড়ে সৈয়দপুর খালে। এই খালের মুরাদপুর ইউনিয়নের বশরত নগর আছে রাবার ড্যামটি। ওই খাল দিয়েই তিন ছড়ার পানি বঙ্গোপসাগরে যায়। তাই রাবার ড্যামটি সংস্কার প্রয়োজন। তবে ড্যামটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া অবৈধ দখলদার এবং পর্যাপ্ত খাল খনন না করায় পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। তৎকালীন সময়ে অবৈধ দখলদারদের দখলের সুযোগ দেয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।