এরশাদ জমানায় তুমুল তুখোড় প্রভাবশালী জাতীয় ছাত্রনেতাদের একজন আমাদের সুজন ভাই(খোরশেদ আলম সুজন) । আমার পরম শ্রদ্ধেয়।
এরশাদ পরবর্তী কথিত গণতন্ত্রের শাসনকালে , বিশেষ করে একাত্তরের ঘাতক গোলাম আজমের চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে জনসভা প্রতিরোধ আন্দোলনসহ পরবর্তীতে ৭১'এর যুদ্ধাপরাধী বিচার আন্দোলনে সুজন ভাইয়ের ভূমিকা কখনোই ভোলার মত নয়।
২৬ জুলাই ১৯৯৪ । চট্টগ্রামে ঘাতক গোলামের জনসভা প্রতিরোধ আন্দোলনে সহযোদ্ধা এহসানুল হক মনির মৃত্যুর পর ২৭ জুলাই তার লাশ নিয়ে আমরা যখন দারুল ফজল মার্কেটস্হ চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয় অভিমুখে প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হই , তখন পুলিশ মুহুর্মুহু গুলি আর টিয়ার শেলে আমাদের দফায় দফায় ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালায়। আমরাও তাতে দমে যাইনি । ইট পাটকেল যা ছিল তার সবই ভাগ্যে জোটে পুলিশের। সেদিন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মত কয়েকজন সাংবাদিকও বেদড়ক পুলিশের হামলায় পড়েন। গুলি আর টিয়ার শেলের মধ্যেও আমরা সড়কের এপাড় ওপার হয়ে অবস্থানের এক পর্যায়ে সুজন ভাইয়ের বজ্রশ্লোগান যেন আমাদের সাহসের মশাল জ্বালিয়ে দেয় বুকে । একপর্যায়ে সুজন ভাইসহ আমরা মুহুর্মুহু গুলি থেকে বাঁচতে কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটির পাহাড়ের ঢালুতে আশ্রয় নিই। -এমন তুমুল উত্তাপের দিনসহ গণতন্ত্রের অভিযাত্রায়, সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ, মাদক মৌলবাদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আরো নানাভাবে পাশে পেয়েছি আমাদের সেই সুজন ভাইকে ।
রাজপথের জীবনবাজি রাখা যোদ্ধা আমাদের সুজন ভাই বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। কখনো কাট্টলী-সীতাকুণ্ড, কখনো বন্দর-পতেঙ্গা আসনে তাঁর মনোনয়ন প্রাপ্তির প্রত্যাশায় বন্দর শহরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের একাংশে উদ্বেলিত ঢেউ গণমাধ্যমের কর্মী হিসেবে আমাদের অনেকেরই ভাবনার জগতে দোলা দেয়। গেল নির্বাচনে মনোনয়ন না পাওয়ায় ফেসবুকে তাঁর সন্তানের আবেগী স্ট্যাটাস আমার হৃদয়ও নাড়া দেয়।
একটা সময় অনেকের প্রত্যাশা ছিল দানু ভাইয়ের (বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী ইনামুল হক দানু) পরে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বুঝি সুজন ভাই'ই হতে পারেন ! আমি কিন্তু সে ভাবনা একবারও ভাবতে পারিনি। মধ্যখানে মাঠের রাজনীতির চেয়ে ব্যবসায় মনোযোগীতা সুজন ভাইয়ের এই সম্ভাবনা ম্লান করে দেবে জানতাম।
অন্যদিকে অনেকটা আড়ালে থেকেও কেন্দ্র হতে তৃণমূল নিজের স্বকীয়তা বেশ দাপটের সাথেই গড়ে তোলেন অনেকটা সমসাময়িক সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা আ জ ম নাছির উদ্দিন। সংগঠনের সদস্যপদও তাঁর ছিল না তখন । অথচ আমি বরাবরই আশাবাদি ছিলাম নাছির ভাইয়ের উপর নেত্রীর আস্হার প্রতি । তখন আমাদের এই সুজনভাইসহ অনেকেই আমার এমন অবস্থানে বা নাছির ভাইয়ের প্রতি আমার পক্ষপাতে ভ্রু কুঁচকাতেন। অনেকে আবার আড়ালে আবডালে বাজে কথাও বলতেন। আজ সেই চিত্র নেই । আজ মধুবনে মৌমাছির ভীড় শুধু নয়, কাকেরাও মৌমাছি রুপ ! কাকের বয়ানে শ্বেত কপোত পালায় !
সে যাই হোক, জানতাম দীর্ঘ বঞ্চিত নেতা নাছির ভাইকে নেত্রী স্বীকৃতি দেবেনই। আর তাই হল। শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু কন্যার আষ্হাতেই ক্রমে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মেয়র হলেন নাছির ভাই।
হঠাৎ বিস্মিত হলাম সেই সিটি মেয়রের সাথে সুজন ভাইয়ের গতকালের (১৩মে,২০১৯) বৈঠকে। 'নাগরিক উদ্যোগ'র আহ্বায়ক পরিচয়ে আমাদের নেতা সুজন ভাই নগরপিতাকে ১৪দফা দিয়েছেন। বেশ ভাল ।
তবে সাংগঠনিকভাবে আমার কিছু প্রশ্ন আছে ।
চট্টগ্রাম নাগরিক উদ্যোগ সংগঠনটির নেতৃত্বে একসময় ছিলেন আমাদের চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন(সিইউজে)'র সাবেক সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা বিশিষ্ট কলামিস্ট ও উন্নয়ন সংগঠক মুহাম্মদ ইদ্রিস। একটা সময় নেপথ্যে এটি পুরোটা টিকিয়ে রেখেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক ও সংগঠক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী। আমি সেই শুরু থেকেই তাঁদের কর্মীর মতই এই উদ্যোগের সারথী। ইদ্রিস ভাইয়ের প্যানেলে সিইউজে'র নির্বাচনে আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও অংশ নিয়েছিলাম। দীর্ঘ সাংগঠনিক ধারাবাহিকতায় একটি পর্যায়ে এসে আমি যখন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন(সিইউজে)'র সভাপতি হলাম তখন পেশাজীবী বিভিন্ন ফোরামের নেতৃবৃন্দ, সনাতনী সম্প্রদায়ের ঘনিষ্ঠজনেরা ও অনুজপ্রতীম সাংস্কৃতিক সংগঠক খোরশেদ আলমসহ অনেকেই আমাকে নাগরিক উদ্যোগের দায়িত্ব নিতে বললে সেই থেকে অগ্রজ- অনুজদের পরামর্শে এর আহ্বায়ক হিসেবে কাজ করি। চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতা রোধ, খাল খনন, সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ, আগুনসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এবং সরকার ও প্রশাসনের ভাল উদ্যোগগুলোকে সমর্থন দিয়ে বিভিন্ন কর্মীসূচী গ্রহণ করে আসছি। আমাদের শুধু একটি গোলটেবিল বৈঠকেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইউএসটিসি, প্রিমিয়ার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় উপাচার্যগণসহ বন্দর, চউক, চসিক, ওয়াসা, আইনজীবী সমিতি, বিএমএ, শিক্ষক সমিতি, সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেসক্লাব, সাংস্কৃতিক, উন্নয়ন ও নারী সংগঠনগুলোর বর্তমান ও প্রাক্তন নেতৃবৃন্দ- শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ এবং দায়িত্বশীল প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধি, নগর পরিকল্পনাবিদেরা এমনকী মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্রছাত্রী শিশু কিশোর প্রতিনিধিরা ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চট্টগ্রামের শীর্ষ নেতৃবৃন্দও সমবেত হন।
চট্টগ্রামে আমরাই নাগরিক উদ্যোগ থেকে জাতীয় শোক দিবসে 'নাগরিক শোকযাত্রা' করে আসছি। ভয়াল ২১আগস্টে হতাহতের নিন্দা প্রতিবাদ, ঘাতকদের বিচার দাবি , মাদক ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক কর্মসূচিও করি আমরা। এছাড়া চট্টগ্রামে উন্নয়ন বরাদ্দে অপ্রতুলতার প্রতিবাদ, মেয়রকে মন্ত্রী মর্যাদা না দেয়া, উন্নয়নে উৎকোচ দাবির প্রতিবাদ ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে কোন ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে আমরা মাঠে সজাগ রয়েছি ।
বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নাগরিক উদ্যোগের পক্ষে আমরা জননেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর পুত্র বর্তমান শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ চট্টগ্রামের মহাজোট প্রার্থীদের সমর্থন দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অদম্য অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে মাঠে থেকেই কাজ করি । সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে এসবের ব্যাপক খবর প্রকাশিত হয়। গুগল চার্চেও এসবের প্রমাণ মিলবে।
গেল জাতীয় নির্বাচনের পূর্বাপর চট্টগ্রামের একাধিক পত্রিকায় নাগরিক উদ্যোগের নামে সুজন ভাইয়ের অসংলগ্ন অপরিণামদর্শী ও অনাকাঙিক্ষত তৎপরতা দেখে বিস্মিত হই। একটা প্রেসনিউজে দেখি আমাদের পিতৃতুল্য শিক্ষাবিদ ও সাবেক ছাত্রনেতা এস এম ফজলুল হক নাগরিক উদ্যোগের আহ্বায়ক ! আর তাঁর বাসায় মত বিনিময় করতে গেলেন এটির প্রধান উপদেষ্টা খোরশেদ আলম সুজন ! !
স্যার আমাকে পুত্রবত স্নেহ করেন । সংশয় জাগানিয়া এই সংবাদ দেখে ফজলুল হক স্যারকে ফোন দিয়ে কুশলাদি বিনিময়ের এক পর্যায়ে জানতে চাইলাম তিনি (স্যার) নাগরিক উদ্যোগের আহবায়ক কিনা। সুজন ভাই তাঁর বাসায় কোন বৈঠক করেছেন কিনা? --এসব প্রশ্নে ফজলুল হক স্যার জানিয়ে দেন তিনি এসবের কিছুই জানেননা। শুধু জানালেন সুজন ভাই চার/পাঁচজন লোক নিয়ে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। চা নাস্তা খাওয়া দাওয়া আর কিছু আড্ডা হয়েছে । এর বাইরে ওই সংগঠনের সাথে তাঁর(স্যারের) কোন সম্পর্কই নেই বলে জানালেন।
এদিকে গতকাল চসিক মেয়রের সাথে সুজন ভাইয়ের বৈঠকের খবরে দেখলাম সুজন ভাই নিজেই এখন আহ্বায়ক এই নাগরিক উদ্যোগের। তিনি আর প্রধান উপদেষ্টা নন। অন্যদিকে ফজলুল হক স্যারের নামই আর নেই এই সংবাদে। এত বড় একজন শিক্ষাবিদকে তিনি কেনই বা 'আহবায়ক'ঘোষনা দিয়ে প্রেসনিউজটি দিলেন আবার কেনইবা তাঁকে চুপিসারে সরিয়ে নিজেই আহ্বায়ক হলেন তা আমার ধোপে টিকলো না।
এমন করে সংগঠনের নাম দখল ও পদ দখলের খবর আমার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকলেও আমি একটি কারনে বেশ খুশী।
দলীয় কর্মী নই আমি। দলের নেতৃত্বের কোন পর্যায়ের পদও আশা করিনি কখনো । নিছক রাজনীতি সচেতন গণমাধ্যম কর্মী কিংবা নাগরিক উদ্যোক্তা বা পিতা মুজিবের আদর্শের অনুসারী হিসেবে হাল আমলে আমার বেশ ভাল লাগে যখন দেখি দুঃসময়ে আ জ ম নাছির উদ্দিন ভাইয়ের তীব্র বিরোধিতায় মশগুল থাকা আর আমাদের মন্ডুচটকানো মানুষগুলো আজ
নানা উপলক্ষে নানা ব্যানারেই সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের কাছে যান।
মেয়রের কাছে সুজন ভাই দফার পর দফা দিতেই পারেন। কিন্তু মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হয়ে তাঁকে যদি দলের সাধারণ সম্পাদক ও সিটিমেয়রকে এতগুলো দফা দিতে হয়, তবে কী প্রশ্ন জাগে না, আওয়ামী লীগ কী তবে কোন কাজই করেনি ? আওয়ামী লীগের সহসভাপতির ভিন্ন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে কিংবা ভিন্ন ব্যানারে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হবেই বা কেন? তবে কী তিনি প্রমাণ করতে চান, আওয়ামী লীগে থেকে গণমুখী দাবি দেয়া যায় না, তাই ভিন্ন প্লাটফর্ম ?
প্রিয় সুজন ভাই,
ভিন্ন ব্যানারে নাগরিক দুর্ভোগের কথা বলে দলের ভাবমূর্তিকে এমনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার আগে দলীয় পদটি ছাড়তেই পারতেন।
জানিনা আমার এমন প্রত্যাশায় আপনার মনে কোন ব্যাথা লাগছে কিনা, তবে আমার খুব ব্যাথা লাগে মনে, যখন দেখি ক্ষমতায় থেকে একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ অন্য অনেক কিছুর মতই নাগরিক সমাজের সংগঠন বা প্লাটফর্মগুলোও দখলে নিয়ে মূলত বঙ্গবন্ধু কন্যার লক্ষ আদর্শের বিরুদ্ধেই কাজ করেন।
(১৪মে, ২০১৯)
(রিয়াজ হায়দার চৌধুরী: সহসভাপতি, বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও আহ্বায়ক, চট্টগ্রাম নাগরিক উদ্যোগ)