সাদ্দাম হোসেন,আনোয়ারা, চট্রগ্রামঃ
আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে ( বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে)বিকেল ৩টায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল থেকেই মানুষের ভিড়ে তিল ধারণের ক্ষমতা হারায় সেদিনের রেসকোর্স।
চতুর্দিকে ভারি অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা রক্তচক্ষু নিয়ে পাহারায়। আকাশে উড়ছে হানাদারদের যুদ্ধজঙ্গি বিমান। সারা শহর থেকে স্রোতের মতো মিছিল আসতে লাগলো রেসকোর্স ময়দানের দিকে। মাঠে জমায়েত হতে লাগল সর্বস্তরের বাঙালি। কৃষক,শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, সাংবাদিক,শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী, এমনকি সাদা পোশাকের পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর লোকজন। নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ সবাই দলে দলে জমায়েত হলো সেখানে। পুরো ময়দান পরিণত হলো জনসমুদ্রে।
তাঁদের শুধু অপেক্ষা অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু কখন আসবেন। গণমানুষে স্লোগানের মধ্য দিয়ে বিকেল তিনটা ২০ মিনিটে জনসমুদ্রের মঞ্চে আসেন বঙ্গবন্ধু। সফেদ পাজামা আর হাতকাটা কালো কোট পরে দৃঢ়তার সঙ্গে হেঁটে এসে মঞ্চে উঠলেন দীর্ঘদেহী এই বাঙালি। সেদিন ফাগুনের সূর্য তখনো মাথার ওপর। মঞ্চে আসার পর তিনি জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন। আকাশ কাঁপিয়ে স্লোগান উচ্চারিত হয়, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো,বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা- মেঘনা-যমুনা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ।’
সমবেত বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে জাতির অবিসংবিদিত মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯ মিনিটের ইতিহাস কাঁপানো তার মহান এ দীপ্ত ভাষণে বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দু:খ- ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি...।’ ‘ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না,মানুষের অধিকার চাই।প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র-মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবো। আজো আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।’ মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের
সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা’। বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে দিক নির্দেশনামূলক, স্বাধীনতার মহাকাব্যের মহান কবি বজ্রকণ্ঠে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের শেষ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু প্রতিরোধের ডাক দেন। পাকিস্তানীদের প্রতিরোধের জন্য বাঙালিদের প্রতি তাঁর আহবান ছিলো- ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।
তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে
সব কিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষেরে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।’ - ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।
মাত্র ১৯ মিনিটের কালজয়ী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল স্বাধীনতার চূড়ান্ত আহবানটিই উপহার দেননি, তিনি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, আদালত, ফৌজদারী আদালত, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষেরা কষ্ট না হয়, সে জন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে,সে গুলির হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিক্শা, ঠেলাগাড়ি,রেল চলবে। … সেক্রেটারিয়েট ও সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গভর্নমেন্ট দপ্তর,ওয়াপদা- কোন কিছুই চলবে না। …আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব…আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।’
৭ মার্চের এইদিনে সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যে যেখানে ছিল সবাই জড়ো হয়ে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনছিল
গভীর আগ্রহ ভরে। তাছাড়া বিভিন্ন এলাকার সাধারণ
মানুষের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আহবান ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য মাইক লাগিয়ে ভাষণ প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। কিছু সময়ের জন্য যেনো থমকে গিয়েছিল স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। সর্বত্র আকাশে বাতাসে ভেসে আসছিলো শুধু বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ। কিন্তু সবার অখ- মনোযোগের মধ্যে হঠাৎ রেডিও প্রচার বন্ধ হয়ে গেলে নতুন করে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। রাত ৮টায় জাতীয় সংবাদ বুলেটিন শেষ হওয়ার পরে পাকিস্তান সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জহিরুল হক, চট্টগ্রাম বেতারের বার্তা সম্পাদক সুলতান আলীকে টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মূল পয়েন্টগুলো ডিকটেশন দিয়ে তা’ প্রচার করতে বলেন। এরপর চট্টগ্রাম বেতার থেকে আবার বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার শুরু হয়। রাত সাড়ে ৮টায় প্রথমে সিলেট রেডিও, তারপর রংপুর ও রাজশাহী থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করা হয়। রাত ৯টার পরে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে কর্ণেল এম আর মুজিবুর রহমান চৌধুরী (এম আর চৌধুরী) একজন মেজর ও লেফটেন্যান্টকে নিয়ে
রেডিওতে গিয়ে ভাষণ প্রচার করতে বলেন। ১৯৪৭ সালে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতিসত্তা, জাতীয়তাবোধ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে ভিত রচিত হয় তারই চূড়ান্ত পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ছাত্র- কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
বাঙালি স্বাধীনতার ইতিহাসে ৭ই মার্চ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। কারণ ’৭১ সালের এই মার্চ মাসেরই ২৫ তারিখ গভীর রাতে, মানে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এসেছিলো; শুধু তাই না, ২৫ মার্চ গভীর রাতে, এদেশের নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী। সে ঘটনা বাঙালি জাতি কখনো ভুলবে না, ভুলতে পারে না।
আজ দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার এবং জাতীয় পত্রিকাসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। চট্টগ্রামেও আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন সংগঠন ৭ মার্চ উপলক্ষে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
বর্তমান সরকার দেশ থেকে ক্ষুধা,দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা ও সন্ত্রাস চিরতরে দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়
প্রতিজ্ঞ। যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করাও বর্তমান সরকারের নির্বাচনি অঙ্গীকার। এসব অঙ্গীকার পূরণে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের ঐকান্তিক সমর্থন ও সহযোগিতা কামনা করি। ‘স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’য় পরিণত করা ছিল বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লালিত স্বপ্ন। আমাদের মহান নেতার সে স্বপ্ন পূরণ করতে সমাজ থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষাসহ নানা সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণে আমাদের অব্যাহত
প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।