নিজস্ব প্রতিবেদক । ।
চট্টগ্রামের করোনা শনাক্তের হার একদিনের ব্যবধানে বেড়ে গেল । তাছাড়া আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে মৃত্যুর সংখ্যাও। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১১ জন মারা গেছেন। যার মধ্যে ৪ জন নগরের, বাকি ৭ জন বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। একই সময়ে নতুন করে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৪৩৮ জন । করোনা শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এদিকে করোনার পাশাপাশি মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু নিয়ে মানুষ মহা যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে চট্টগ্রামের মানুষ ।
মঙ্গলবার (১৭ আগস্ট) চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদন সুত্রে জানা যায় , বিভিন্ন ল্যাবের এন্টিজেন টেস্টসহ চট্টগ্রামের ৯ টি ও কক্সবাজারের একটি ল্যাবে ২ হাজার ২৫০ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৪৩৮ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের নমুনা পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে চট্টগ্রাম নগরের ২৭৯ জন এবং ১৫৯ বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা।
চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত মোট করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৯৫ হাজার ৫১৬ জন। মোট শনাক্তের মধ্যে চট্টগ্রাম নগরেরই ৭০ হাজার ৫৪ জন। বাকি ২৫ হাজার ৪৬২ জন বিভিন্ন উপজেলার। করোনা আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত মোট ১ হাজার ১৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৬৫৩ জন চট্টগ্রাম নগরের। আর বিভিন্ন উপজেলায় মারা গেছেন ৪৮৬ জন।
চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলার মধ্যে রাউজান উপজেলায় সর্বাধিক ৪৯ জন করোনা রোগী পাওয়া গেছে । তাছাড়া সীতাকুণ্ডে ৩১ জন, বোয়ালখালীতে ২১ জন, আনোয়ারায় ১৫ জন, বাঁশখালীতে ১১ জন, হাটহাজারীতে ৬ জন, পটিয়ায় ৫ জন, চন্দনাইশে ৪ জন, সাতকানিয়া ও ফটিকছড়িতে ৩ জন করে, মিরসরাইয়ে ২ এবং লোহাগাড়ায় ১ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এদিন রাঙ্গুনিয়া ও সন্দ্বীপে কোন করোনা রোগী পাওয়া যায়নি ।
অন্যদিকে চট্টগ্রামে গত কয়েকদিন যাবত করোনার সংক্রমণ হার নিম্নমুখী হলেও নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু । ডেঙ্গুর আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন । করোনায় যখন জনজীবন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনি নতুন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে ভয়ানক ডেঙ্গু। দিন দিন চট্টগ্রাম নগরজুড়ে মশার অসহনীয় বংশবিস্তারের ফলে করোনার ফাঁকেই আড়ালে আরেক প্রাণঘাতী রোগ ডেঙ্গু উঁকি দিয়ে যেন চোখ রাঙাচ্ছে ।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে , শুধুমাত্র গত দেড় মাসেই চট্টগ্রামে ৬৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। যাদের মধ্যে মারা গেছেন দুই জন। চিকিৎসকরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের মধ্যেই মারাত্মক রূপ নিতে পারে এই ডেঙ্গু। তাই সবাই সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যে দেখা যায়, শুধুমাত্র গেল দুই সপ্তাহেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২৫ জন ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া গত ৯ আগস্ট পর্যন্ত ৩০ জন আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। যারা উপজেলা ও নগরীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে ডেঙ্গু শনাক্ত হন। তার আগের মাসে তথা জুলাইয়ে ৯ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হওয়ারও খবর দেয়া হয় স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে। যাদের দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ চলতি বছরের গেল দেড় মাসেই শুধু চট্টগ্রামেই ৬৪ জন ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে ।
এদিকে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জন্য পৃথক কর্নারও ইতোমধ্যে স্থাপন করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের ১৩ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডে পৃথক কর্নারটি গত সপ্তাহে স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য আলাদা চিকিৎসারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে চমেক হাসপাতালের ডেঙ্গু কর্নারে দশজন আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বাকিরা ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মো. সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, চলতি বছরের বিগত মাসগুলোতে তেমন কোন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়নি। তবে চলতি মাসেই রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। যদিও এসব রোগীদের চিকিৎসার জন্য পৃথক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে চিকিৎসকরাও উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের ডেঙ্গু পরীক্ষার পাশাপাশি কোভিড পরীক্ষাও করাচ্ছেন। হাসপাতালে স্বল্পমূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা হয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, কারও যদি জ্বর বা উপসর্গ থাকে, তাহলে কম নাম মাত্র মূল্যেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে পারবে।
অন্যদিকে, করোনার এই মুহূর্তে সচেতন না হলে ডেঙ্গু চোখ রাঙাতে পারে এমন আশঙ্কা করে ফৌজদারহাটের বাংলাদেশ ইনফেকশাস ডিজিজেজ (বিআইটিআইডি) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুনুর রশিদ বলেন, ‘এ মৌসুম ডেঙ্গুর। ২০১৯ সালের এই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকাতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হতে শুরু করেছেন। কিন্তু বর্তমানে যেহেতু করোনার বিষয়টি সামনে আছে, তাই অনেকেই সেদিকে নজর দিচ্ছে না। কিন্তু এটিও নীরব ঘাতক হতে পারে। তাই এ বিষয়ে এখন থেকেই বেশি সচেতন হতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম কাজই হচ্ছে কোন উপসর্গ দেখা দিলে কোভিড এবং ডেঙ্গু দুটোর জন্যই আলাদা পরীক্ষা করাতে হবে। প্রয়োজন হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। তবে বাসায় বসে থাকলে হয়তো ক্ষতির মুখেও পড়তে হতে পারে। তাই এখন থেকে অবশ্যই সকলকে সচেতন হতে হবে।’
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘চিকিৎসকদের পাশাপাশি সকল চিকিৎসা কেন্দ্রে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, জ্বরে আক্রান্ত বা কোভিড পরীক্ষা করাতে কেউ আসলে অথবা সন্দেহ হলে যেন ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হয়। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য বিভাগ থেকেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে বাসা বাড়িতে জমে থাকা পানি অন্তত তিনদিন পরপর পরিষ্কার করতে হবে। কোথাও যেন পানি জমে না থাকে সে বিষয়ে খেয়াল করতে হবে।’
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরীর লালখানবাজার ও দেওয়ানহাট এলাকায় এডিস মশার লার্ভা ও পিউপির অস্তিত্ব মিলেছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, তাদেরও বেশিরভাগই এই দুই এলাকার বাসিন্দা।
এদিকে চট্টগ্রাম নগরীর ৯৯টি এলাকার ৫১টি স্পট এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ৬টিসহ মোট ৫৭টি স্পট থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ১৫টি স্পটে শতভাগ এডিস মশার লার্ভা শনাক্ত করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। তারা বলেন, এসব লার্ভা সংগ্রহ করে কিছুদিন রাখার পরে মশার উৎপত্তি হয়। এ থেকে গবেষকরা বুঝতে পারেন, কোন কোন পজিশনে মশার লার্ভার মধ্যে এডিস মশার উপস্থিতি থাকে। গবেষণাকালে বাড়ির ফুলের টব, পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের পাত্র, দোকানের ব্যাটারির সেল ও টায়ার এবং রাস্তার পাশের পাইপে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে মিলেছে এডিস মশার লার্ভা। এসব এলাকা থেকে পাওয়া লার্ভার শতভাগই ছিল এডিস মশার।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাসে দেশে ২৭২ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। জুলাইয়ে এসে একলাফে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় দুই হাজার ২৮৬ জনে।
অন্যদিকে আগস্টের প্রথম দুই দিনে দেশে ৫২৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এর মধ্যে রোববার (১ আগস্ট) থেকে সোমবার (২ আগস্ট) সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ২৮৭ জন। চলতি বছর এটি একদিনে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের রেকর্ড।
মেজবাহ খালেদ / এন ই / সিআইডি ;