মেজবাহ খালেদ । ।
করোনায় আক্রান্ত চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে মারা যান শোভা রানী নাথ (৬০)। ভয়ে তার দুই ছেলে কিংবা স্বজনের কেউ এগিয়ে আসেননি লাশ সৎকারে। পরে খবর দেওয়া হয় গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশকে। খবর পেয়ে জেনারেল হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে রওনা হন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে লাশের গোসল দেন এ কমিটির নারী সদস্যরা। শোভা রানীর বাড়ি চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার ১১ নম্বর মঘাদিয়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মাস্টারপাড়ায়। দুপুরে লাশ নিয়ে এলাকায় পৌঁছালে তৈরি হয় নতুন বিপত্তি। করোনা ছড়ানোর আতঙ্কে লাশ এলাকায় প্রবেশ করতে দিতে রাজি নন প্রতিবেশী ও এলাকাবাসীর কেউ কেউ। তারা অ্যাম্বুলেন্স ঘিরে ধরে লাশ নামাতে বাধা দেন। তারপর বাধাদানকারীদের সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টা চলে বাকবিতণ্ডা। পরে মীরসরাই ও সীতাকুণ্ড গাউসিয়া কমিটির সদস্যরা হিন্দু রীতিতেই সৎকার করলো উক্ত হিন্দু মহিলার লাশ।
সেদিনের প্রসঙ্গে সীতাকুণ্ড গাউসিয়া কমিটির অন্যতম সদস্য তৌহিদুল আলম বলেন, খুব অমানবিক দৃশ্য। লাশ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি দুই ঘণ্টা। যেখানে এমন কাজে সবাই আমাদের সহায়তা করার কথা, সেখানে আমাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে। আমরা এটা কল্পনাও করিনি। আমরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছি। অথচ সারা বছর যাদের সঙ্গে উনি চলাফেরা করলেন, মৃত্যুর পর তাঁকেই ফেলে গেলেন তারা। পরে অনেক বুঝিয়ে আমরা তাদের রাজি করাই। অবশেষে বিকাল নাগাদ মরদেহ সৎকার করি। এটি গত ৪ জুলাই এর ঘটনা ।
২৯ আগস্ট করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যান সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা মুহাম্মদ হাবীব (৪৫)। গভীর রাতে সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ গ্রামে নিয়ে আসেন স্ত্রী। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনে স্বজন, প্রতিবেশী ও স্থানীয় ব্যক্তিরা কেউ ঘর থেকে বের হননি। রাত পেরিয়ে ভোর হলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে খবর পেয়ে লাশ দাফনে ছুটে আসেন গাউসিয়া কমিটি ১০ থেকে ১২ জন স্বেচ্ছাসেবক। সকালে তাঁরা লাশ গোসলের পর কাফন পরিয়ে জানাজা শেষে দাফন করেন।
১১ জুন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার পোমরা ইউনিয়নের করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যান সুব্রত বিকাশ বড়ুয়া (৬৭) নামের এক বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা। পরিবারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা চাওয়া হয় গাউসিয়া কমিটির। লাশ অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানো, গোসল দেওয়া থেকে শুরু করে শেষকৃত্যের সব কাজ করেন এই সংগঠনের রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া শাখার কর্মীরা। মারা যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত বিকাশ বড়ুয়ার ছেলে তমাল বড়ুয়া বলেন, তাঁর বাবার লাশ গোসল ও শেষকৃত্যের সব কাজ করেন গাউসিয়া কমিটির স্বেচ্ছাসেবীরা। তাঁদের এই সহযোগিতা তাঁর কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
এভাবে ধর্ম–বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে দিন–রাত করোনায় আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ দাফন ও সৎকারে ছুটে চলেন তাঁরা। গাউছিয়া কমিটিতে আছেন শক্তিশালী মহিলা টিম । পুরুষ স্বেচ্ছাসেবীর পাশাপাশি নারী স্বেচ্ছাসেবীরা প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। গত ১২ জুলাই শুক্রবার ৪৮ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৩ মরদেহের গোসল-কাফন করান তাঁরা । অর্থাৎ প্রতি সাড়ে তিন ঘণ্টায় তারা একটি করে লাশের গোসল ও কাফন পরান। এ সময় তারা বিশ্রামের সুযোগ পেয়েছেন মাত্র দুই ঘন্টা। এরমধ্যে কেউ কেউ করোনা শনাক্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আর কেউ কেউ উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও গোসল-কাপন-দাফন টিমের প্রধান সমন্বয়ক এডভোকেট মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার জানান, দেশব্যাপী পুরুষ মানবিক টিমের পাশাপাশি তিন শতাধিক মহিলাও গোসল, কাফনের কাজে অংশগ্রহণ করছেন। তারা প্রত্যেকেই স্ব-উদ্যোগে এবং প্রশিক্ষণ নিয়েই এ পবিত্র ও মানবিক কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন ।
তিনি আরো বলেন, গত বছর করোনার ছোবলে যখন দেশবাসী দিশাহারা। আপনজনের মৃত লাশ রেখে যখন পালিয়ে বাঁচি অবস্থা, তখন পুরুষের লাশ কাফন-দাফন ও সৎকারে গাউসিয়া কমিটি কর্মসূচি নেয়। এরপর ক্রমান্বয়ে মৃতের হার বাড়তে থাকলে সেইসাথে শেষ পথযাত্রায় মহিলার হার বৃদ্ধি পেতে থাকলে গাউসিয়া কমিটি মহিলা শাখা নিজস্ব টিম গঠন করে মানবিক সেবায় নেমে পড়ে। পুরুষদের মত নারী স্বেচ্ছাসেবকরাও নিজেদের নিবেদন করেছেন এ কাজে। রাত-দিন যে সময় যার মোবাইলে রিং পড়ে সাথে সাথেই তারা প্রস্তুত হয়ে যায়। একাজ করতে তাদের কোন বিরক্তিও নেই। এই কাজ এখন তাদের কাছে অন্য দশটি স্বাভাবিক কাজের মতই হয়ে গেছে। শুধুমাত্র মানবসেবার জন্যই তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করছেন।
তিনি জানান, করোনা মহামারীর সময় ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের আগস্ট ২৪ পর্যন্ত সারাদেশে ৪৬০৩ জনের দাফন ও সৎকার করে। এর মধ্যে শুধু চট্টগ্রামে ৩৬০৩ জনের দাফন ও সৎকার করা হয়। বাকী ১০০০ জন দেশের বিভিন্ন স্থানের বাসিন্দা । এর মধ্যে ৫১ জন মুক্তিযোদ্ধা, কারাবন্দী কয়েদী ৪ জন, ৪৩ জন হিন্দু, বৌদ্ধ ৬ জন, ১ জন মারমা উপজাতি, ১ জন খ্রিষ্টান ও ৩২ জন অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ। গাউসিয়া কমিটির নিবেদিন প্রাণ স্বেচ্ছাসেবীরা এ কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ মৃতের লাশ দাফন-সৎকারের পাশাপাশি করোনায় আক্রান্ত ২৪ হাজার ১১৮ জন রোগীকে অক্সিজেন সেবা, চারটি অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে বিনা ফিতে প্রায় ৬ হাজার ৫০০ জন রোগী পরিবহন, অজ্ঞাত ব্যক্তিদের সড়ক ও বাড়ি থেকে এনে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণসহ ১২ হাজারের বেশি মানুষকে ওষুধসহ চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। লকডাউনে ২০২০ সালে ১ লক্ষ পরিবারকে এবং ২০২১ সালের লকডাউনে ১ লক্ষ পরিবারকে খাদ্য ও অর্থ সহায়তা দিয়েছেন। চট্টগ্রাম নগরীর ৬টি স্পটে ভ্রম্যমাণ গাড়িতে করোনা টেস্টের সুবিধা পাচ্ছেন প্রতিদিন ৪০ জন করে । তাছাড়া ২০২১ সালে বৃক্ষ রোপণ ও বিতরণ করেন ২ লক্ষ চারা । যা এখনো চলমান আছে ।
সংগঠন সূত্র জানা যায়, করোনাসংকটের শুরুতে সংগঠনটির কর্মীরা নিজ নিজ এলাকার উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত লাশ দাফনকাজের প্রশিক্ষণ নেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি অনুসারে সুরক্ষা পোশাক পরে দাফনকাজ সম্পন্ন করা হয়। এ কাজ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত সংগঠনটির কোনো স্বেচ্ছাসেবী করোনায় আক্রান্ত হননি।
১৯৮৬ সালে চট্টগ্রামের আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহ.) এই গাউসিয়া কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর কেন্দ্রীয় কার্যালয় চট্টগ্রামের দেওয়ান বাজারের দিদার মার্কেটে। এই সংগঠনের তত্ত্বাবধানে দেশে ২০০–এর বেশি মাদ্রাসা পরিচালিত হয়।
সংগঠনটির কেন্দ্রীয় পরিষদের সচিব শাহজাদ ইবনে দিদার জানান, সারা দেশে এই সংগঠন সামাজিক ও ধর্মীয় কাজ করে। দেশের ৫০ জেলায় রয়েছে তাঁদের সংগঠনের বিস্তার। উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে এই সংগঠনের প্রায় ৭০০ কর্মী করোনায় মৃতদের দাফনে কাজ করছেন।
লাশ দাফনকাজের সমন্বয় কমিটির প্রধান মোসাহেব উদ্দিন বখতিয়ার বলেন, শুরুতে লাশের জানাজা পড়ানোর জন্য ইমামও পাওয়া যাচ্ছিল না। এ কারণে বাংলা শিক্ষিত হয়েও তাঁকে ইমামতি করতে হয়েছে। অনেক সময় পিপিই সংকটে পড়তে হচ্ছে তাঁদের। তিনি মনে করেন, সরকারিভাবে আরও সহযোগিতা পেলে সামনে আরও ভালো কাজ করতে পারবেন।
এদিকে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির গোসলের জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গাউছিয়া কমিটির উদ্যোগে ভ্রাম্যমাণ গোসলখানা চালু হয়েছে। মঙ্গলবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে এটি উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ কামরুল হাসান।
গাউছিয়া কমিটির উদ্যোগে একটি অ্যাম্বুলেন্সকে ভ্রাম্যমাণ গোসলখানা হিসেবে তৈরি করা হয়। হাসপাতাল কিংবা বাড়িতে মারা যাওয়া করোনা রোগীকে এই গাড়ির ভেতর গোসল ও কাফন পরানোর যাবতীয় ব্যবস্থা রয়েছে।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে কামরুল হাসান বলেন, দেশে-বিদেশে করোনায় মৃত ব্যক্তির প্রতি অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। এহেন ন্যক্কারজনক ব্যর্থতায় বাংলাদেশে করোনা মহামারির শুরু থেকে গাউসিয়া কমিটির কর্মীরা জীবন বাজি রেখে মানবতার সেবায় নিবেদিত আছেন। তিনি এ মহৎ পুণ্যময় কাজে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে সর্বসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান।
গাউসিয়া কমিটির করোনা রোগী সেবা ও মৃত কাফন-দাফন কর্মসূচির প্রধান সমন্বয়ক মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার বলেন, অ্যাম্বুলেন্সে লাশের গোসলের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সংবলিত এ ভ্রাম্যমাণ গোসলখানা বাংলাদেশে প্রথম সংযোজন। করোনাকালে রোগীকে গোসল ও কাফনে নানা বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন গাউছিয়া কমিটির স্বেচ্ছাসেবকেরা। সেই অভিজ্ঞতা থেকে লাশের গোসল-কাফনের জন্য ভ্রাম্যমাণ গোসলখানাটি তৈরি করা হয়। এখন থেকে কারও বাসার সামনে কিংবা কোনো জায়গায় করোনা রোগীকে গোসল করাতে সমস্যা হলে ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে সব করা যাবে।