বিশেষ প্রতিবেদক। ।
সংরক্ষিত প্রায় ১৫০ একর বনের কেওড়া বাগান উজাড় করে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত থেকে সৈয়দপুর বাকখালী পর্যন্ত স্থানীয় প্রভাবশালী মহল কর্তৃক শতাধিক মৎস্য প্রকল্প করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই করা হয়েছে বনের কেওড়া বাগান উজাড় করে। ফলে সংরক্ষিত বন পুরোপুরি বিলুপ্ত হওয়ার আশংকা তৈরির পাশাপাশি মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে ওই এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সীতাকুণ্ড উপজেলার গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত থেকে সৈয়দপুর পর্যন্ত বেড়িবাঁধের পশ্চিমে দুই কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত মাটি কেটে কেওড়া গাছ ঘিরে উঁচু পাড় তৈরি করে দখলদাররা। পরবর্তীতে গাছ নিধন করে গড়ে তুলে বিশাল আকৃতির মৎস্য প্রকল্প। বেড়িবাঁধ ঘেঁষে গড়ে তোলা এসব মৎস্য প্রকল্পের সবগুলোই অবৈধ বলে জানিয়েছেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা। তবে দখলদারদের কাছে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা। শুধু তাই নয়, বন রক্ষা করতে গিয়ে কখনো কখনো দখলদারদের হাতে মারধরের শিকার হতে হচ্ছে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের। আর অবৈধ হলেও নির্বিঘ্নে মৎস্য প্রকল্পের ব্যবসা চালিয়ে নিচ্ছে বনখেকোরা।
সরেজমিন দেখা গেছে, গুলিয়াখালী থেকে মধ্যম ভাটেরখীল পর্যন্ত ২৫ একর বনে ছোট বড় প্রায় ২০টি মৎস্য প্রকল্প রয়েছে; অভিযোগ আছে এ অংশ দখলে নিয়েছেন নুরুল হক নামের এক ব্যক্তি।
এরপরই ভাটেরখীল ঘাটঘর এলাকা থেকে উত্তরে সৈয়দপুর পর্যন্ত ৫৫ একর বন বিভাগ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১ নং খাস খতিয়ানভুক্ত জায়গায় মৎস্য প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। বিশাল আকৃতির এ অংশে রয়েছে অর্ধশতাধিক প্রকল্প; এ অংশটি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলের (জাগদল) সাবেক নেতা বিএসসি তাহেরের দখলে রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
একই পয়েন্টের মাঝখানে ২২ একর খাস খতিয়ানভুক্ত বন দখল করে মৎস্য প্রকল্প পরিচালনা করছে বেনামী ৮০ জনের একটি সমিতি। ওই সমিতির দায়িত্বে সৈয়দপুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আইয়ুব আলী রয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। একই সমিতিতে রয়েছেন সরকার ও বিরোধীদলীয় অনেক নেতাকর্মীও। বিশাল আয়তনের বন ও পাউবোর জায়গা দখল করে মৎস্য প্রকল্প চালানো ওই সমিতির নেই কোন নাম-নিবন্ধন ও বৈধ লিজও। কেবল জনশ্রুতি আছে ওই মৎস্য প্রকল্প আশিজনের দখলে।
সৈয়দপুর ইউনিয়নের অন্তরখালী সমুদ্র উপকূলের আরেকটি অংশের নিয়ন্ত্রণে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মো. ফসির নামের ওই বীর মুক্তিযোদ্ধার দখলে রয়েছে ২২ একর বনভূমি। যেখানে দীর্ঘদিন আগে থেকে মৎস্য প্রকল্প করা হয়েছে এবং বাধাহীনভাবে চালানো হচ্ছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। এসব প্রকল্পের আশেপাশের কেওড়া গাছ উজাড় করা হয়েছে বহু আগেই।
প্রকল্পে যাতায়াতের সুবিধার্থে উপকূলের মাটি কেটে নির্মাণ করা হয়েছে প্রশস্ত রাস্তাও। শ্রমিকদের আবাসনের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে একাধিক টিনশেড ঘর। বনে মানুষের অবাধ বিচরণের ফলে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে। সেইসাথে বন বিলুপ্ত হয়ে প্রকৃতিতে কমছে সবুজ গাছপালা। দুর্বল হয়ে পড়ছে প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। বনের গহীনে মৎস্য চাষের ফলে হ্রাস পাচ্ছে উপকূলের ধানি জমিও।
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন আগে থেকে এখানে বন ধ্বংস করে মৎস্য প্রকল্প করা হয়েছে। স্কেভেটর দিয়ে বনের গাছপালা উপড়ে ফেলে খালি করা হচ্ছে। তারপর সময়-সুযোগ বুঝে নিশ্চিত করা হচ্ছে দখল। দখলকারীরা প্রভাবশালী জানিয়ে স্থানীয়রা আরও জানান, কারও কোন লিজ নেই। আগে লিজ থাকলেও এখন সেগুলোর মেয়াদ নেই। যেখানে প্রকল্প করা হয়েছে সেগুলো সরকারি খাস খতিয়ানের জমি। এখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গাও আছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই সবগুলো প্রজেক্ট করা হয়েছে। এসব প্রজেক্টের ফলে আমরা গবাদিপশু চরাতে পারছি না, চাষাবাদ করতে পারছিনা। কেননা কোথাও এক টুকরো জায়গা খালি রাখা হয়নি। গেল মৌসুমেও যেসব জায়গা চাষের উপযোগী ছিল, সেখানে এখন দখল করে মৎস্য প্রকল্প করা হয়েছে। পুরো বনটাই তারা গিলে খাচ্ছে।
বন বিভাগের তথ্যমতে, এসব দখলকারীদের কারও বৈধ লিজের কাগজপত্র নেই। কেবল লিজ আছে এমন মৌখিক জনশ্রুতি ছড়িয়েই বছরের পর বছর দখল টিকিয়ে রেখেছে ওই দখলদাররা।
এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড উপজেলার উপকূলীয় বন বিভাগের ভাটেরখীল বিটের বিট কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সীতাকুণ্ড উপকূলে বনের জায়গা দখল করে শতাধিক মৎস্য প্রকল্প করা হয়েছে। শুধুমাত্র ভাটেরখীল বিটেই ১৫০ একর বন দখল করা হয়েছে। কিছুদিন আগেও ভাটেরখীল ঘাটঘর এলাকায় নতুন একটি প্রকল্পে ইউএনও স্যার এসে লাল পতাকা স্থাপন করে গেছেন। দখলদাররা কিছুই মানছে না। এতো বিশাল কাণ্ড তারা করেছে সরকারি জায়গায়, যে কেউ দেখলে অবাক হবে। ঘর, স্থাপনা, রাস্তা তৈরি করে মস্তবড় কারবার করেছে তারা।’
সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমি একদিন বিএসসি তাহেরের প্রকল্পে যাই। সেখানকার ম্যানেজারের কাছে কাগজপত্রের কথা জানতে চাইলে সে বললো সবকিছু তাহেরের কাছে আছে। আজ পর্যন্ত আমি তাকে পাইনি৷ শুধু বিএএসি তাহের নয় কোন দখলদারকেই আমি চোখে দেখিনি। শুধু এটুকু জানি এটা ওমুকের, ওটা তমুকের। সরকারি খাস সম্পত্তি কীভাবে তারা ভোগদখল করছে আমার বুঝে আসে না। তাদের পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে বিলুপ্তির পথে উপকূলীয় বন। বন্যপ্রাণীরা তাদের আবাসস্থল ত্যাগ করছে। মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।’
এ বিষয়ে উপকূলীয় রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘যেখানে মৎস্য প্রকল্প করা হয়েছে, সেগুলো সরকারি খাস খতিয়ানের জমি। তবে এখানে বনের একটা অংশও পড়েছে। ফলে বন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা এখনো কাউকে নোটিশ দিইনি।’
সীতাকুণ্ড সদর ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা শাহ আলম বলেন, ‘সরকারি খাস জমিতে কোন কিছু করা যাবে না। আমরা নির্দেশনা মোতাবেক জায়গাগুলো চিহ্নিত করছি। কারো নামে বন্দোবস্তি আছে কি না সেটা জানতে রেকর্ড দেখা হয়েছে। কারো কোন বন্দোবস্তি আমরা খুঁজে পায়নি। সেখানে সবগুলোই সরকারি খাস খতিয়ানের জমি।’
সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমরা দখলকৃত জায়গাগুলোতে লাল পতাকা উড়াচ্ছি। আজও বেশকিছু জায়গায় লাল পতাকা স্থাপন করা হবে। এরপর থেকে সেসব জায়গায় কোন কিছু করার সুযোগ নেই। বনকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা হবে। উপকূলীয় এলাকায় কারো নামে কোন লিজ বা বন্দোবস্তি নেই। এগুলো সম্পূর্ণ অবৈধ।’
মেজবাহ খালেদ / এন ই / সি আই ডি ;