বিশেষ প্রতিবেদক । ।
সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট - বায়েজিদ লিংক রোডের দুইপাশে পাহাড় কাটা ও দখল বন্ধ না হলেও এবার নতুন করে দখল হচ্ছে পানির ঝিরি। এতে বর্ষাকালে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল আটকে মারাত্মক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতে পারে। তবে কারা এসব পানির ঝিরি দখল করছে, আশেপাশের কেউ সত্যতা স্বীকার করেনি। পানির ঝিরি দখল প্রক্রিয়ার পাশেই রয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রুপের মালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা ভূমি।
জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট টোল রোডের মুখ পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে বায়েজিদ ফৌজদার হাট লিংক রোড। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে প্রায় ৩২০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। বর্তমানে প্রকল্পটির মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে কাটা ১৬টি পাহাড়। পাহাড়গুলো ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে এবং শুরু হয়েছে ধস। প্রকল্পের আওতায় ৬ কি.মি. রাস্তা নির্মাণে কাটা হয় ওই ১৬ পাহাড়। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে পাহাড় কাটায় ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তরে ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয়ে শুনানিতে তলব করে সিডিএকে। শুনানিতে পাহাড় কেটে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, পাহাড়ের উপরিভাগের মাটি এবং ভূমির বাইন্ডিং ক্যাপাসিটি নষ্টসহ পরিবেশ-প্রতিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করার অভিযোগ করা হয়। শুনানি শেষে ১০ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার ৫৫৩ টাকা জরিমানা নির্ধারণ করেন অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) রুবিনা ফেরদৌসী। এরপর ১৩ ফেব্রুয়ারি আরেক শুনানিতে ওই প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডকেও ৫ কোটি ২৩ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মো. মোয়াজ্জম হোসাইন। পরবর্তীতে স্পেক্টা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড তাদের বিরুদ্ধে করা জরিমানার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে আপিল করে। তাদের আপিলের প্রেক্ষিতে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিবের নির্দেশে পুনরায় তদন্ত শুরু করে পরিবেশ অধিদপ্তর। গত সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ের গঠিত টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তারা পাহাড় দখল, কাটা এবং ঝিরি দখলের বিষয়টির সরেজমিনে সত্যতা পান।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং এন্ড এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মদ মাসুদ হাসান পাটোয়ারী বলেন, ‘আমরা স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের সেই প্রজেক্ট এরিয়া ভিজিট করেছি। এটি সত্যি যে, তারা পাহাড় কেটেছে। এতে পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে ওখানে জলাশয়ের যে কথা বলা হয়েছে, ভূমি অফিসের তথ্য মতে ওই স্থানে কোনো জলাশয় নেই। সবই পাহাড় শ্রেণি। পাহাড়ি ঝিরি বা হ্রদ এগুলো পাহাড়েরই অংশ। আমরা বিভিন্ন দপ্তর থেকে তথ্য সংগ্রহ করছি। এখনো দুটি তথ্য পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। সবগুলো তথ্য পেলে আমরা মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে রিপোর্ট জমা দেব।’
এদিকে প্রকল্পের সড়ক নির্মাণ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এর মাঝে সড়কটি ব্যবহারের জন্যেও খুলে দিয়েছে সিডিএ। ফলে চট্টগ্রাম মহানগরীর যানজট অনেকাংশে কমেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সড়কটি খুলে দেওয়ার পর দুইপাশে অবাধে দখল হচ্ছে পাহাড়। পাহাড় দখল বাদেও পাহাড়ি পানির ঝিরি দখল শুরু করেছে দুর্বৃত্তরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সিডিএ’র প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সেই আলোচিত পাহাড় কেটে তৈরি করা স্থাপনার পাশেই পানির ঝিরির (শুকনো হ্রদ) মাঝামাঝিতে আড়াআড়ি বড় বড় জিও ব্যাগ ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। ১০-১৫ জনের নারী-পুরুষ শ্রমিক এসব ভরাট কাজে নিয়োজিত আছেন। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত ৮-১০দিন ধরে এখানে বড় বড় জিও ব্যাগ ফেলে ঝিরির মধ্যখানে ভরাট কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে কারা এসব ঝিরি দখলে জড়িত তাদের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শী আবদুল করিম নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘এখানে বড় বড় রাঘববোয়ালরা পাহাড় দখল, ঝিরি দখল, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করছে। সিডিএ রোড করায় এখন এসব পাহাড়ি জমিগুলোর দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ চলছে এখানে।’ তিনি বলেন, ‘এখন ঝিরির মধ্যখানে বাঁধ দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। এতে বৃষ্টি হলে পানির স্বাভাবিক গতিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। আশেপাশের পাহাড়গুলোতে ধস আরও বাড়বে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্সের প্রকল্প পরিচালক রবিউল হক বলেন, আমাদের বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলার জন্য মুখপাত্র হিসেবে দিদার সাহেব রয়েছেন। তিনি প্রতিবেদককে দিদার সাহেবের সাথে কথা বলার অনুরোধ করেন। পরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মীরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক নাছির উদ্দিন দিদার বলেন, ‘ঝিরিতে কারা জিও ব্যাগ ফেলে দখল করছে সেটি আমরা অবগত নই। আমাদের কেউ এ কাজে জড়িত নেই।’ স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্সের পাশে রয়েছে জঙ্গল সলিমপুর ভূমি মালিক সমিতির মালিকানাধীন জায়গাও। তাদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনটির প্রতিনিধি হারাধন দাশ বলেন, ‘আমাদের পাশে ঝিরি কারা দখল করছে সে বিষয়ে আমরা জ্ঞাত নই। ওখানে আমাদের একটি অফিস রয়েছে। এখন ভরাট কিংবা ভৌত কোনো কাজ চলছে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, ‘জঙ্গল সলিমপুর মৌজাটি পরিবেশ অধিদপ্তর জেলা কার্যালয়ের অধীনে। আমরা পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারি। দখল কিংবা ঝিরি ভরাটের বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন দেখভাল করে।’
সীতাকুণ্ড উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘জঙ্গল সলিমপুর মৌজায় কিংবা স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্সের প্রকল্পের পাশে পাহাড়ি ঝিরি দখল ও ভরাটের বিষয়টি আমরা জানা নেই। তবে যারা এই ভরাট দখলের সাথে জড়িত, তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
সুত্র. আজাদী
মেজবাহ খালেদ / এন ই / সি আই ডি;