মেজবাহ খালেদ। ।
স্বামী সন্তান নিয়ে গৃহবধূ মরিয়ম বেগমের ভালোই কাটছিলো সংসার। সুখের ঘরে হঠাৎ দুর্দিন নেমে আসে । দীর্ঘ রোগে মারা যান তাঁর স্বামী । এর মাত্র চার দিন যেতেই চার সন্তানসহ অসহায় স্বামীহারা এই গৃহবধূকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয় । স্বামীর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়া এই নারী বাপের বাড়ির মুখাপেক্ষী হতে চাননি । নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম শুরু করেন তিনি।
মাত্র ৬০০ টাকা বেতনে চাকরি নেন উন্নয়ন সংস্থা এনজিও ইপসাতে। নিজে ও চার সন্তানের ভরণ পোষণ কঠিন হলেও তিনি থেমে থাকেননি । এগিয়ে গেছেন সামনের দিকে। নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করায় খুশি হয়ে ইপসার কর্মকর্তারা তাঁর প্রতি বাড়তি আন্তরিকতা দেখিয়ে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন। ইপসার সার্বিক সহযোগিতা ও নিজের প্রচেষ্টায় মরিয়ম বেগমকে আর পেছনের দিকে তাকাতে হয়নি। এর মধ্যে সে অর্থনৈতিক সাফল্য লাভের পাশাপাশি চার সন্তানকেই সুশিক্ষিত করে তোলেন। আর এই কঠোর জীবনসংগ্রামের স্বীকৃতি স্বরূপ সীতাকুণ্ড উপজেলায় অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনকারী হিসেবে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হন মরিয়ম। তিনি সীতাকুণ্ড পৌর সদরের মধ্যম মহাদেবপুর গ্রামের আয়েশা ভিলার বাসিন্দা মৃত মুছা মিয়ার স্ত্রী।
মরিয়ম বেগম ছাড়াও এ উপজেলায় আরও দুই নারী জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁরা হলেন সীতাকুণ্ড পৌর সদরের সোবাহানবাগ এলাকার মো. জসীম উদ্দিনের স্ত্রী আছমা আক্তার ও বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের বাড়বকুণ্ড বড়ুয়া পাড়ার বুলবুল বড়ুয়ার স্ত্রী শিখা বড়ুয়া। নিজ নিজ সংগ্রামী জীবনের স্বীকৃতি হিসেবে এ সাফল্য পেয়েছেন তারা ।
এর মধ্যে আছমা আক্তার জয়িতা হয়েছেন শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী ক্যাটাগরিতে এবং শিখা বড়ুয়া জয়িতা হন সমাজ উন্নয়নে সাফল্য অর্জনকারী হিসেবে।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নিজে স্কুল খুলে সমাজের শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া ও এলাকায় নারী জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়নে ভূমিকা রেখে জয়িতা হন শিখা বড়ুয়া।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শিখা সব সময় গ্রামের শিক্ষা ও আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে এককভাবে চেষ্টা করে গেছেন। তিনি নিজেই একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলেছেন । যে বিদ্যালয়ে অনেক ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করে শিক্ষিত হয়েছে। পাশাপাশি নৈতিকতা শেখানোর জন্য খোলেন একটি ধর্মীয় স্কুলও। এ ছাড়া তিনি মহিলা ইউপি সদস্য পদে নির্বাচন করলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে টানা ৫ বছর এলাকার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। গ্রামের মানুষের জন্য তৈরি করেন রাস্তা, স্থাপন করেন টিউবওয়েল এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে প্রতিমুহূর্তে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেকে । আর এসব বিবেচনায় তিনি হয়েছেন জয়িতা।
অন্যদিকে শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী ক্যাটাগরিতে জয়িতা নির্বাচিত হওয়া আছমা উপজেলার বাড়বকুণ্ড সিসিসি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োজিত আছেন। ২০১৬ সালের শিক্ষা সপ্তাহে বিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ শ্রেণি শিক্ষক হিসেবে পুরস্কৃত হন তিনি। এর আগে তিনি এনজিও সংস্থা ইপসা ও ভার্কে চাকরি করে সেখানেও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করে প্রশংসিত হয়েছেন। পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে এম. এ ও বি. এড ডিগ্রি অর্জনকারী এই নারী তাঁর পরিশ্রম ও একাগ্রতার স্বীকৃতি স্বরূপ জয়িতা হয়েছেন।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুন নাহার সময়ের আলোকে বলেন, স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদান রেখে সমাজ ও নিজের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন করেছেন মরিয়ম, আছমা ও শিখা। তাঁদের এসব কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ শেষে আমরা তাঁদের ২০২০-২১ সালের শ্রেষ্ঠ জয়িতা ঘোষণা করেছি। আমরা বিশ্বাস করি, তাঁদের সংগ্রামী জীবন অন্য অনেক নারীর জন্য প্রেরণা হয়ে উঠবে ।