ইসলামের পথনির্দেশঃ
মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সময়টুকু মানুষ কবর তথা সমাধিস্থলে অবস্থান করবে। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় এই সময়কাল ‘বারজাখ’ বলা হয়। বারজাখ অর্থ দুটি জিনিসের মধ্যবর্তীয় অন্তরাল। পবিত্র কোরআনে মৃত্যু থেকে কিয়ামতের মধ্যবর্তী সময়কে ‘বারজাখ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন সে বলে, হে আমার প্রতিপালক, আমাকে পুনরায় প্রেরণ করুন। যাতে আমি সৎকাজ করতে পারি যা আমি আগে করিনি। না, এটা হওয়ার নয়। এটা তো তার একটি কথা মাত্র।
তাদের সম্মুখে বারজাখ থাকবে উত্থান দিবস পর্যন্ত। ’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ৯৯-১০০)
মৃত্যু থেকেই নতুন জীবন : মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মানুষ নতুন জীবনে প্রবেশ করে। সেটা হলো ‘আলমে বারজাখ’। ইমাম শাবি (রহ.) বলেন, বারজাখ হলো দুনিয়া ও আখিরাতের মধ্যবর্তী একটি জীবন।
যা যেমন পার্থিব জীবন নয়, তেমন পরকালীন জীবনও নয়। (তাফসিরে ইবনে কাসির : ৩/৩২১)
ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসাবাদ : কবরের জীবনের প্রথম ধাপ হলো ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসাবাদ। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মৃত ব্যক্তি বা তোমাদের কাউকে যখন কবরে রাখা হয়, তখন কালো বর্ণের এবং নীল চোখবিশিষ্ট দুজন ফেরেশতা আসেন তার কাছে। তাঁদের মধ্যে একজনকে মুনকার এবং অন্যজনকে নাকির বলা হয়। ’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১০৭১)
যা জিজ্ঞাসা করা হবে : বারা ইবনে আজিব (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসের ভাষ্য মতে, কবরে তিনটি প্রশ্ন করা হবে।
তা হলো, তোমার প্রতিপালক কে? তোমার দ্বিন বা ধর্ম কি? তোমার নবী কে? (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩১২০)
প্রশ্নের উত্তরে মুমিন ব্যক্তি বলবে, আমার প্রতিপালক আল্লাহ, আমার ধর্ম ইসলাম, আর তিনি হলেন আমাদের মাঝে প্রেরিত রাসুল মুহাম্মদ (সা.)। তখন ফেরেশতারা তাদের বলবে, জাহান্নামে তোমার জন্য নির্ধারিত স্থান দেখে নাও।
আল্লাহ এই স্থানের পরিবর্তে তোমাকে জান্নাতে স্থান দান করেছেন। অতঃপর তাকে জান্নাত ও জাহান্নাম উভয় স্থান দেখানো হবে। অন্যদিকে মুনাফিক ও অবিশ্বাসীরা উত্তর দেবে আমি জানি না। তখন তাকে বলা হবে, তুমি জানতে চাওনি, তুমি পাঠ করোনি। এরপর সে শাস্তির মুখোমুখি হবে। (শহরুত তহাবিয়্যা : ২/৫৭২-৫৭৮)
কবর না দিলেও কি শাস্তি হয় : আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিশ্বাস হলো মৃত্যুর পর সবাই মুনকার-নাকিরের প্রশ্নের মুখোমুখি হবে এবং বারজাখের শাস্তি ও সুখ ভোগ করবে। চাই তাকে দাফন করা হোক বা না হোক। এমনকি তার দেহ যদি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, হিংস্র প্রাণী তাকে খেয়ে ফেলে, সে পুরে ভস্ম হয়ে যায়, তাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হয় অথবা ছাই বানিয়ে তার দেহাবশেষ বাতাসে উড়িয়ে দেয় বা সমুদ্রে ডুবে যায়। যেমন নুহ (আ.)-এর সম্প্রদায় সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তাদের অপরাধের জন্য তাদের নিমজ্জিত করা হয়েছিল এবং পরে তাদের দাখিল করা হয়েছিল আগুনে। এরপর তারা কাউকে আল্লাহর মোকাবেলায় পায়নি সাহায্যকারী। ’ (সুরা নুহ, আয়াত : ২৫)
ঘুমিয়ে থাকবে মুমিন ব্যক্তি : আলমে বারজাখে মুমিন ব্যক্তি জান্নাতের সুখ-শান্তি উপভোগ করবে এবং প্রশান্তচিত্তে ঘুমিয়ে থাকবে। হাদিসে এসেছে, মুমিনের উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে মুনকার-নাকির বলবে, আমরা জানতাম তুমি এ কথাই বলবে। তারপর সে ব্যক্তির কবর দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ৭০ গজ করে প্রশস্ত করা হবে এবং তার জন্য এখানে আলোর ব্যবস্থা করা হবে। তারপর তাকে বলা হবে, তুমি ঘুমিয়ে থাকো। তখন সে বলবে, আমার পরিবার-পরিজনকে সুসংবাদ দেওয়া জন্য আমি তাদের কাছে ফিরে যেতে চাই।
তারা উভয়ে বলবে, বাসরঘরের বরের মতো তুমি এখানে এমন গভীর ঘুম দাও, যাকে তার পরিবারের সবচেয়ে প্রিয়জন ছাড়া আর কোনো ব্যক্তি জাগিয়ে তুলতে পারে না। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১০৭১)
এদিকে ইঙ্গিত দিয়ে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কবর হলো জান্নাতের উদ্যানগুলোর একটি উদ্যান অথবা জাহান্নামের গর্তগুলোর একটি গর্ত। ’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৪৬০)
জাহান্নামিদের জন্য শাস্তি : জাহান্নামিরা মৃত্যুর পর থেকেই শাস্তির মুখোমুখি হবে। আল্লাহ বলেন, অতঃপর আল্লাহ তাকে তাদের ষড়যন্ত্র অনিষ্ট থেকে রক্ষা করলেন এবং কঠিন শাস্তি পরিবেষ্টন করল ফিরাউন সম্প্রদায়কে। তাদের উপস্থিত করা হয় আগুনের সম্মুখে সকাল-সন্ধ্যা এবং যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন বলা হবে, ফিরাউন সম্প্রদায়কে নিক্ষেপ কোরো কঠিন শাস্তিতে। ’ (সুরা মুমিন, আয়াত : ৪৫-৪৬)
শহীদের মৃত্যু নেই : আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের বাহ্যত মৃত্যু হলেও, প্রকৃতপক্ষে তারা জীবিত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে রিজিকপ্রাপ্ত।
ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের কখনোই মৃত মনে কোরো না; বরং তারা জীবিত এবং তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তারা জীবিকাপ্রাপ্ত। আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের যা দিয়েছেন তাতে তারা আনন্দিত এবং তাদের পেছনে যারা এখনো তাদের সঙ্গে মিলিত হয়নি তাদের জন্য আনন্দ প্রকাশ করে এ জন্য যে তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না। ’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৬৯-১৭০)
মৃত্যুর পরও যারা নেকি লাভ করবে : আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ঈমানদার ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার যেসব কাজ ও তার যেসব পুণ্য তার সঙ্গে যুক্ত হয় তা হলো, যে জ্ঞান সে অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে এবং তার প্রচার করেছে, তার রেখে যাওয়া সৎকর্মপরায়ণ সন্তান, কোরআন, যা সে ওয়ারিশি সূত্রে রেখে গেছে অথবা মাসজিদ, যা সে নির্মাণ করিয়েছে অথবা পথিক-মুসাফিরদের জন্য যে সরাইখানা নির্মাণ করেছে অথবা পানির নহর, যা সে খনন করেছে অথবা তার জীবদ্দশায় ও সুস্থাবস্থায় তার সম্পদ থেকে যে দান-খয়রাত করেছে, তা তার মৃত্যুর পরও তার সঙ্গে (তার আমলনামায়) যুক্ত হবে। ’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪১)
মুমিন আত্মার সম্মিলন : আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, মৃত্যুর পর মুমিন ব্যক্তির আত্মাকে যখন মুমিনদের রুহগুলোর কাছে নিয়ে যান। তোমাদের কেউ প্রবাস থেকে এলে তোমরা যেরূপ আনন্দিত হও, মুমিনদের রুহও ওই নবাগত রুহকে পেয়ে ততোধিক আনন্দিত হয়। মুমিনদের রুহ নবাগত রুহকে জিজ্ঞাসা করে যে অমুক ব্যক্তি দুনিয়াতে কী কাজ করেছে? তখন ফেরেশতারা বলেন, তার সম্পর্কে তোমরা কি জিজ্ঞাসা করবে? সে দুনিয়ার চিন্তা-ভাবনায় ছিল। যখন নবাগত রুহ বলে, সে কি তোমাদের কাছে আসেনি? তখন আসমানের ফেরেশতারা বলেন, তাকে তার বাসস্থান হাবিয়াতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ১৮৩৩)