কেন পড়তে হবে বই
সংগৃহিত ছবি।

অনলাইন ডেস্কঃ

পৃথিবীর ইতিহাস যাদের নাম লিখে রেখেছে তারা বইয়ের মানুষ! হয় লিখেছেন, নয় তো বই পড়েছেন। পড়েছেন যারা তারা তো পড়েছেনই। কিন্তু লিখেছেন যারা তারা কি পড়েননি! নিশ্চয় পড়েছেন। পাঠ তাদেরও অপরিহার্য। পড়েই তারা লিখেছেন। আর তারা লিখেছেন বলেই পড়েছেন পাঠক। মোটা দাগে বলতে হয়- লেখার জন্য পড়তে হয়। পড়ার জন্যও লিখতে হয়। না লিখলে বইয়ের জন্ম হবে কিভাবে! বই না জন্মালে পড়বে কি মানুষ! সাদা কথা হলো- উন্নত জীবনের মানুষ মাত্রই বইয়ের মানুষ। কোনো না কোনোভাবে বই-ই তাদের নিত্যসঙ্গী।

জীবনের বড় অংশ বইকে দান করছেন তারা। বইও অকাতরে জ্ঞান উপহার দিয়েছে তাদের। উপহার দিয়েছে জীবনের আলো। তারা সঙ্গ নিয়েছেন বইয়ের। বইও সঙ্গী হয়েছে তাদের। দৃষ্টি খরচ করেছেন বইয়ের পাতায়। বইয়েই জমে ছিল মন। আত্মার পরিতৃপ্তি ছিল বইয়ের সান্নিধ্যে। খ্যাতির বর্তমান নদীও তেমন করেই প্রবাহিত। তেমন করেই কল্লোলিত হবে ভবিষ্যতের ঢেউ।

বইয়ের জীবন অন্যরকম জীবন। দূরদৃষ্টির জীবন। নম্র ও ভদ্রতার জীবন। সুন্দর ও সমন্বয়ের জীবন। প্রাণ ও প্রেরণার জীবন। গভীর উপলব্ধির জীবন। বই বিনে কী করে সুশীল হবে মানুষ। জ্ঞানের জ্যোতি কী করে তুলবে বুকের ভেতর।

তবুও জিজ্ঞাসাটি জাগে- বই পড়তে হবে কেন? কী আছে বইয়ের ভেতর! কী নেয়ার আছে বইয়ের জগৎ থেকে! কেন বই এতটা দরকারি? জীবনের সাথে বইয়ের সম্পর্ক কোথায়? বইবাজার কেমন? এর দরদামে হাঁকাহাঁকি আছে কি! বইমূল্য শোধ দেন কারা! বই কেন সম্পদ! সম্পদ হলে কেমন সম্পদ! একে পুঁজিবাদী ব্যাংকে জমা রাখা যায়! এর কোনো মুনাফা আছে! বণিক গোষ্ঠীর সুনজরে থাকে কি বই! এর অভাবে কোনো মানুষ না খেয়ে মরে কি! অন্তত অসুস্থ হয় কি? নইলে এর জন্য কেন বিনিয়োগ করতে হবে এতটা সময়! কেন বহন করতে হবে এর বোঝা! কত চোখের দৃষ্টিই তো পড়ে না বইয়ের পাতায়। কত হাত বহন করে না বইয়ের ভার।

চোখের সামনে খোলা হয় না বইয়ের কোনো পৃষ্ঠা। বইয়ের ভাষা অপরিচিত তাদের কাছে। আস্ত জীবন পার হয়ে যায় বইহীন! অর্থ-সম্পদে তারাও তো জমজমাট। নামধামেও আছে অলঙ্কারময় তকমা। শরীরে তথথলে মেদ। ঠোঁটের কোনায় খুশির ঝিল্লি­। হাসিতে জয়ের উত্তাপ। তুলনায় বইপড়ুয়াদের চেহারা অভাবী। টানাটানির সংসার। একদিক ঢাকলে আরেক দিক উদাম। এক পাশ ভরলে অন্য পাশ খালি।

এদের দিকে সমাজের দৃষ্টি নিতান্ত অবহেলার। তবে ব্যবধানটি কোথায়! বইপড়ুয়া আর অপড়ুয়াদের সেতুটি কতটা বড়-ছোট!
আবুল ফজলের একটি বচন পাঠ করা যাক। তিনি বলেছেন- কিছু শিক্ষিত ব্যক্তি যারা নিজেরা বই পড়ে না অন্যকেও বই পড়তে নিরুৎসাহিত করে- এরা নিঃসন্দেহে মূর্খ না হলেও শিক্ষার কলঙ্ক।
কথাটি বিবেচনার দাবি রাখে। কলঙ্কিত লোকের জীবন সুন্দর হয় কি?

পাঠ্যবই ছেড়ে আসার পর জীবনে আর কোনো বইয়ের সান্নিধ্য নেয়নি এমন লোকের সংখ্যা নেহাতই কম নয়! কেউ কেউ নিলেও তাতে বড় বদহজম তাদের। বমি বমি ভাব। উগরে দিতে পারলেই বাঁচে। বইয়ের রাজ্য তাদের কাছে বড়ই নির্জীব! বিস্ময়ের হলেও এসব নির্জলা সত্য! এ সত্যটুকু আমাদের কোথায় নামিয়ে রেখেছে এ কথা ভাবছি কি আমরা?

না আমরা তেমন করে ভাবছি না। ভাবতে পারছি না। ভাবতে শিখিওনি। আমাদের ভাববার বিষয় খুব সীমিত। পথ ফুরিয়ে যাওয়া কানাগলির মতো। আয়তনে সামান্য। এই ধরুন- দ্রুত সম্পদওয়ালা হওয়ার তৃষ্ণা! রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়ার গোপন পদ্ধতি! আকস্মিক বড় নেতা হয়ে ওঠার কৌশল! অন্যের পথ দুর্গম করে তোলা যায় কিভাবে! অন্যেরটি নিজের করার বাহানা! চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার মতো কোনো গাড়ি কিংবা প্রাসাদ। যখন তখন ব্যবহারযোগ্য ক্ষমতার শিং! স্বার্থরক্ষার প্রভাবশালী চাবুক! এ তো আমাদের সা¤প্রতিক সমাজের লোকদের মনোচিত্র! সাফল্যের এসব বিদ্যায় দক্ষ এখন আমাদের শিক্ষিতজন!

এসব অর্জনে বইয়ের সাহায্য নেয়ার কী প্রয়োজন! কী এমন ঠেকা বইয়ের কাছে। বই বিনে দিব্যি পাল ওড়ায় জীবনের নাও! তবে কেন পড়তে হবে বই?
সত্যিই তো, কেন পড়তে হবে বই? হ্যাঁ তবুও পড়তে হবে বই! হয়তো এককথার মোড়কে এর জবাব আঁটানো সহজ হবে না। কেন? কারণ, বইয়ের বুকে ঘুমিয়ে আছে মহাকাল! আর মহাকালের বুকেই জমে আছে পৃথিবীর তাবত ইতিহাস! এ ইতিহাসের দরজাগুলোর নামই তো বই! মানুষের ইচ্ছার বিভ‚তি! স্বপ্নের পতাকা! পাওয়ার আনন্দ! না পাওয়ার বেদনা! এসবই মহাকালের দেয়ালে অঙ্কিত। 

দেয়ালের এসব লেখা পাঠের আকাক্সক্ষা উন্মুক্ত হবে যার তাকেই ফিরতে হবে বইয়ের দিকে। তাকেই পড়তে হবে কালের এসব বিস্ময় দহন। সুতরাং বই পড়ার বিকল্প কিছু নেই যেমন, তেমনি হতেও পারে না এর বিকল্প কিছু। এ কারণেই লিও টলস্টয়ের উচ্চারণটি স্মরণীয়- জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন- বই, বই আর বই।

বেন জনসনের কথাটি কঠিন হলেও বিবেচনার। তিনি বলেছেন, যে বই পড়তে ভালোবাসে না, সে বর্বর! ব্রাউনিংয়ের বচনটি হলো- বইগুলো সফল আর জীবনগুলো ব্যর্থ!
আরেকটি চমৎকার উক্তি আছে চার্লস ল্যাম্বের। তিনি বলেছেন, বই পড়তে যে ভালোবাসে তার শত্রæ কম!
আরো একটি অসাধারণ বচন স্মরণ করা যায়। ফ্রান্সিস বেকনের এটি- যখন বক্তারা নিশ্চুপ হয়ে যায়, তখন বই সোজাসাপটা কথা বলে।
কী অদ্ভুত উক্তি! মানুষের মুখ যখন চুপ! কিংবা কোনো কারণে সেলাই হয়ে যায় মুখ। তখন বই-ই কথা বলে।
খুব সহজে বইয়ের আশ্রয় নেয়া যায়।

বই জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু! উন্নত মনের নির্মল আনন্দ! নির্ভেজাল সঙ্গী। প্রতিবাদহীন ভালোবাসা। বই এমনই আত্মীয় যার সাথে ঝগড়া হয় না কোনোদিন। এমনই সাথী যে ছেড়ে যায় না কখনো। এমনই বিশ্বস্ত যে কখনো ঘাতক হয়ে ওঠে না।
হতাশায় আগলে রাখে বই। খুব সহজে নির্ভর করা চলে বইয়ের ওপর। মানুষ সবসময় কথা দিয়ে কথা রাখে না। অথচ বই কখনো কথার বরখেলাফ করে না। মানুষ বদলে যায় সহজেই। কোনোমতেই বদলায় না বই। বরং বই হলো সুন্দরের পক্ষে জীবন বদলে দেয়ার তুমুল আয়োজন।

নিঃসঙ্গতায় একান্ত সঙ্গী হয়ে ওঠে বই। সমৃদ্ধ সঙ্গ দেয় একাকিত্বে। অতীত জানতে যেমন ভবিষ্যতের স্বপ্নেও তেমনই। অতীত ও ভবিষ্যতের ফুল দেখার বর্তমান উদ্যান হলো বই। এভাবেই সফল জীবনের গল্প আর ব্যর্থ জীবনের কাহিনী সবই মুখ লুকিয়ে আছে বইয়ের পৃষ্ঠায়।

অতীতে বিচরণের সাধ থাকে যার তাকে পড়তে হবে বই। ভবিষ্যতে পৌঁছানোর স্বাপ্নিক যে তাকে পড়তে হবে বই। বর্তমান সময়ে যোগ্য থাকতে হলেও বই পড়তে হবে। নিজেকে আধুনিক করে তুলতে হলে বই-ই বান্ধব!

বই স্মৃতি ধারালো করে। স্মরণশক্তি তীক্ষè করে। সবুজ করে ব্রেইন। প্রস্তুত করে নতুন চিন্তার বীজতলা।

জাতি হিসেবে আমাদের একটি বিস্ময় অভিধা আছে- আমরা বই না পড়া জাতি! অভিধাটি অবিশ্বাস্য কি! না। মোটেই নয়। বরং আমাদের প্রতিদিনের উচ্চারণে, কর্মে ও ব্যবহারে তারই ধ্বনি উচ্চকিত। আমরা বই না পড়া জাতি এ কথা আর কারো অগোচরে নেই। জাতি হিসেবে আমাদের সভ্যতার চেহারা রুগ্ণ! সংস্কৃতির শরীর জীর্ণশীর্ণ! জ্ঞানের বহর ভীষণ খাটো! ভদ্রতার ছাপচিত্রে মলিন রঙ! আমাদের ভেতররাজ্যে একবার উঁকি দিলেই অজগরের মতো বেরিয়ে আসে নিজেদের আসল রূপ!

মনের দিক থেকে আমরা ভীষণ সঙ্কীর্ণ! বাহ্যিকতায় ভদ্র হতে পারিনি! ঔদার্য কেবলই দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত। সাদা-কালো চিনি না। সত্য-মিথ্যার ফারাক বুঝি না। মানি না ন্যায়-অন্যায়ের ব্যবধান! মুহূর্তে মুহূর্তে দলিত করি বিবেক! লালসার কাছে পরাজয়ে বেশ আনন্দ! অসুন্দর বৈশিষ্ট্যে দারুণ অহঙ্কার! মানুষকে মানুষ ভাবতে শিখিনি। গুণের মর্যাদা নেই! জ্ঞানীর কদর নেই। সত্য অপদস্থ হলে দীর্ঘ হয়ে ওঠে আমাদের হাসি। ইতিহাসের কারখানা আছে আমাদের। খুব কম খরচে ইতিহাস তৈরি হয় এখানে। অপরাধকে ঘৃণা করার রুচি তো নেই-ই। বরং নিয়ত অপরাধী উৎপাদনে আমরা ক্লান্তিহীন! অরুচিকেই অনায়াসে উন্নত রুচির তকমায় বাজারজাত করি।

সমালোচনায় ভীষণ পারদর্শী আমরা! জীবনের সব দরজার জন্য বানিয়ে নিয়েছি রাজনৈতিক চাবি। রাজনীতির বাটখারায় ওজন করি মানবজীবন।
সত্যের চোখে সবসময় অশ্রæ! মিথ্যার ঠোঁটে হাসি ফুরায় না। সব অন্যায় গিলে নিতে শিখেছি খুব! ভয়ঙ্কর দৃশ্যেও আমাদের অন্তর গলে না। মনুষ্যত্বের পরাজয় দেখেও কাঁদে না মন! অচেতন ঘুমে তলিয়ে গেছে প্রতিবাদ।

এত গুণের (!) অধিকারী জাতি আমরা। কেন? কারণ আমরা পরস্পর দোষাদোষীর খেলায় জিততে পারদর্শী! গিবতের নর্দমায় সাঁতার কেটে পদক জোগাড়ে দক্ষ। আমরা পেছন ফেরা জাতি। হাঁটছি ভবিষ্যতের দিকে অথচ অতীতের দিকে মুখ! সুখের জন্য দুঃখ দিয়ে ভরে তুলি জীবনের চারদিক। মনের গহনে হা-হুতাশ। হাহাকার! অতৃপ্তির উত্তাপ! আমার আমার করেই সময় পার! কী করে আমরা জীবনের আনন্দ কুড়াব!

যে বই পড়ে না তার মধ্যে মর্যাদাবোধ জন্মে না- কথাটি জীবনবিদ পিয়ারসন স্মিথের। সত্য চিনতে হলেও বই পড়া চাই। নিজেকে চিনতে হলেও বই-ই মাধ্যম হয়ে ওঠে।
বই-ই জীবনের সব- এ কথা বলছি না। কিন্তু বইহীন জীবন সম্পূর্ণ নয়! ব্যক্তি, জাতি ও দেশের ক্ষেত্রে একই নিশানই উঁচু করা যায়। ভলতেয়ার বলেছেন, সে দেশ কখনো নিজেকে সভ্য বলে প্রকাশ করতে পারে না, যতক্ষণ না তার বেশির ভাগ অর্থ চুইংগামের পরিবর্তে বই ক্রয়ের জন্য হবে। এখানে চুইংগাম একটি প্রতীকী শব্দ। এর তাজা অর্থ হলো- জীবন যাপনের সব উপকরণের মতো কিংবা তারও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে- বই।

পাঠের বিষয়ে জগতের শ্রেষ্ঠ বাণীটি দিয়েছেন বিশ্বজগতের স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে অবতীর্ণ ঐশী বাণীর প্রথম শব্দটিই- পড়ো। কই কারা পড়ে! কেমন পড়ে! কী পড়ে! কতদূর পড়ে! আদৌ পড়ে কি! তবুও নিজেকে উত্তম বিশ্বাসী ভাবা যায়! বলা যায় উন্নত মুসলিম!
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: জীবনের শুরু থেকে শেষ অবধি শিখতে বলেছেন। বলেছেন, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শেখো।
তারপরও শিখি কি আমরা! নাকি শেখার উদ্যম আছে তেমন করে।

সত্যি হলো বইহীন ঘর আত্মাহীন দেহের মতো! বইয়ের মতো সুন্দর কোনো আসবাব নেই। জগতের সব দামি বস্তু মলিন হয়। বই থেকে যায় চিরসবুজ!