অনলাইন ডেস্ক
একুশে পদকপ্রাপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেছেন, কোনো একটি কাজে যদি আপনি সফলতা চান, তবে সেই কাজে আপনাকে লেগে থাকতে হবে। আমার পত্রিকা দৈনিক আজাদীর ৫০ বছর পূর্তির সময় আমি লন্ডনে ছিলাম। সেই সময় বিবিসি খবর পেয়ে আমার একটি ইন্টারভিউ নিয়েছিল। সেখানে আমি বলেছিলাম, আমি আমার স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলেছি। সেই স্বপ্ন ছোঁয়া কিন্তু একটি বিরাট ব্যাপার। কারণ ভারতীয় সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম একটি কথা বলেছিলেন, যে স্বপ্ন আপনি জেগে দেখবেন সেটিই আসল স্বপ্ন। ঘুমিয়ে যে স্বপ্ন দেখেন সেটি সত্যিকারের স্বপ্ন না। এই যে আপনি জেগে স্বপ্ন দেখলেন এবং সেটি যদি আপনি বাস্তবায়িত করতে পারেন তবে আপনার জীবন সার্থক হবে।
গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক মিলনায়তনে উপজেলা পরিষদ এসোসিয়েশন চট্টগ্রাম বিভাগ ও জেলার উদ্যোগে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
উপজেলা পরিষদ এসোসিয়েশন চট্টগ্রাম বিভাগের সভাপতি ও রাউজান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম এহছানুল হায়দর চৌধুরী বাবুলের সভাপতিত্বে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসিবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী।
সংবর্ধনার জবাবে আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, এই যে বলেছি আমি আমার স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলেছি। এটা কেন বলেছি? কারণ আমার বাবা মাত্র ২ বছর আজাদী পত্রিকা চালানোর পরে মারা যান। তারপর আমার ওপর সেই পত্রিকা চালানোর জন্য একটা পবিত্র দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল। আমি তখন সেই কাজকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। তখন আমার একটা ধারণা হয়েছিল, আমি যদি পত্রিকাটা বের করতে না পারি কিংবা বন্ধ করে দিই তাহলে সকলে বলবে আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের ছেলে কোনো কাজের না। মৃত্যুর আগে ছেলেকে বাবা একটা পত্রিকা দিয়েছে সেটি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। তারপর থেকে বিশ্বাস করুন, ৪৫ বছর পর্যন্ত আমি প্রতিদিন ভোর ৪টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্তহকারদের কাছে কাগজ বিলি করেছি। এটা করেছি কারণ আমি যার ওপর নির্ভরশীল, আমি যে কাজ করে আমার জীবন জীবিকা চালাই সেটিকে কখনো কেউ হেয় করতে পারি না। হেয় করা উচিত না। সেটা যত সামান্য কাজই হোক। আপনি যদি এটি ধারণ করে চলতে পারেন, তাহলে জীবনটা এগিয়ে নিতে পারবেন।
একুশে পদকের বিষয়ে তিনি বলেন, একুশ আমার অহংকার। একুশে মানে মাথা নত না করা। আপনারা জানেন, একুশের সঙ্গে আমাদের পরিবার এবং আমাদের প্রেস ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। কারণ একুশের প্রথম কবিতা কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর লেখা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’, সেই কবিতাটি আমাদের প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল এবং সেই কবিতা লালদীঘির মাঠে বিলি করা হয়েছিল। এই কবিতাটি ছাপানোর জন্য আমাদের প্রেসের ম্যানেজার দবির উদ্দিন সাহেবকে জেলে যেতে হয়েছিল। কারণ কবিতাটি ছাপানো রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল ছিল। অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজটা করতে হয়েছে। কিন্তু সুখের কিংবা দুঃখের বিষয় ছিল, সেই কবিতার প্রিন্টার্স লাইনে কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস লেখা ছিল। সুতরাং এখানে কাউকে সাক্ষী দিতে হয়নি। যখন মামলা হলো, তখন আমাদের ম্যানেজার দবিরকে জেলে নিয়ে গেল পুলিশ। তবে ম্যানেজার সাহেব সেই সময় আমার বাবাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন, প্রেসের মালিক এ ব্যাপারে কিছু জানতেন না। সব দোষ আমার। সেই থেকে একুশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এছাড়া এই আজাদী পত্রিকার সাথে আমি ৬২ বছর লেগে আছি। তবে এই একুশে পদক পাওয়াতে আমার একটা লাভ হয়েছে, আমার মৃত্যুর পরে আমার দেশের লাল-সবুজের পতাকা আমার কফিনের ওপর স্থান পাবে।
আইন মতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের যথাযথ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে না পারার বিষয়টি উল্লেখ করে আজাদী সম্পাদক বলেন, কাজের ক্ষেত্রে ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে পরিকল্পনা মাফিক সংগ্রাম করতে হবে। সংগ্রাম মানে রাস্তা অবরোধ কিংবা গাড়ি বন্ধ করে দেয়া না। এক্ষেত্রে আপনারা একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে, সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী এজেন্ডা তৈরি করে সরকারের কাছে তুলে ধরতে পারেন। উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরা যদি সুষ্ঠু সহনীয় পর্যায়ে সরকারের কাছে দাবি দাওয়া উপস্থাপন করতে পারেন আমার মনে হয় সরকারের না দেয়ার কারণ নাই। কারণ জনগণের কাজ করার জন্যই তো আপনারা।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রীয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশ পদক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক। একুশ না হলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামটা হতে পারতো না। একুশ স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা করেছে। এর আগে দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্যারকে সরকার মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দিয়েছিলেন। জীবদ্দশায় খালেদ স্যার অত্যন্ত বিনয়ী একজন ব্যক্তি ছিলেন। শুধু তাই না আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে উনার সুযোগ্যপূত্র একুশে পদকপ্রাপ্ত এম এ মালেক পর্যন্ত সবার মধ্যে এই বিনয়টা আমরা দেখতে পাই। এম এ মালেক চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের অধীনে ‘ক্যান্সার হাসপাতাল ও রিসার্চ ইন্সটিটিউট বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান। সেই ক্যান্সার হাসপাতালের জন্য উনি এক কোটি টাকা অনুদান দিয়েছেন। মানবতার ব্রত নিয়ে উনি লায়ানিজম করছেন। উনি এবং উনার স্ত্রী দুজনই লায়নের সাবেক গভর্নর ছিলেন। ব্যক্তি জীবনে উনি প্রচার বিমুখ একজন মানুষ। প্রচারের জন্য কখনো দৈনিক আজাদী পত্রিকায় উনার ছবি ছাপতে আমরা খুব একটা দেখি না। উনি আজাদী পত্রিকাতে সব চট্টগ্রামবাসীর সুখ-দুঃখ ও সম্ভাবনার বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
তিনি আরো বলেন, সেইদিন এক লোক বলছিলেন, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক যদি ঢাকার হতেন, তাহলে এই একুশে পদকের পুরস্কার তিনি আরো ২০ বছর আগে পেতেন। তারপরেও দীর্ঘ সময় পরে হলেও আমরা উনার হাতে এই পদকটি দেখছি। ভারতবর্ষের প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছিলেন, যে দেশে গুণী ব্যক্তিদের সম্মান জানানো হয় না, সে দেশে গুণী ব্যক্তি জন্ম নেয় না। আজকে আমরা মালেক ভাইকে সম্মানিত করে কেবল উনি সম্মানিত হচ্ছেন না। সম্মাানিত হচ্ছি আমরা সবাই।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে উপজেলা পরিষদ এসোসিয়েশন চট্টগ্রাম বিভাগের সভাপতি ও রাউজান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম এহছানুল হায়দর চৌধুরী বাবুল বলেন, আজাদী শুরু থেকে আজ অবধি চট্টগ্রামবাসীর হৃদয় জয় করেছে-ভালোবাসা জয় করেছে। আজাদী স্বাধীনতা সংগ্রামে-ভাষা আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা রেখেছে।
তিনি নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানসহ সকল জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে বলেন, ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবী জয় করা সম্ভব। আমরা যারা জনপ্রতিনিধি আমাদের উচিত মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করা। তাহলে আপনাকে আমাকে কখনো ভোটারের পিছনে ঘুরতে হবে না।
বাচিকশিল্পী ও আবৃত্তিকার দিলরুবা খানমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, পটিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, সাতকানিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ মোতালেব সিআইপি, উপজেলা পরিষদ এসোসিয়েশন চট্টগ্রাম বিভাগের সাধারণ সম্পাদক ও চন্দনাইশ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আবদুল জব্বার চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি ও আনোয়ারা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক চৌধুরী, বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ এসোসিয়েশন চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক ও ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হোসাইন মোহাম্মদ আবু তৈয়ব। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, পটিয়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ডা. তিমির বরণ চৌধুরী, আনোয়ারা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মৃণাল কান্তি ধর, কর্ণফুলী উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান বানাজা বেগম নিশি, সাতকানিয়া উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আঞ্জুমান আরা এবং পটিয়া উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মাজেদা বেগম শিরু প্রমুখ।
সূত্রঃ দৈনিক আজাদী